ভারতের ভ্যাকসিন কূটনীতি

কোভিড-১৯ মহামারী থেকে পাওয়া আমাদের অন্যতম গুরূত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো বিশ্বজুড়ে দ্রুতগতিতে ছড়াতে পারে এমন রোগ নির্মূলের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। ভ্যাকসিন কূটনীতিসহ বৈশ্বিক স্বাস্থ্য রাজনীতি একারণেই চীন থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম গুরূত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংক্রামক এ রোগের ক্ষেত্রে সারাবিশ্বেই প্রথম পদক্ষেপ ছিল লকডাউন এবং অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া। বিশ্বজুড়ে ঔষধ, মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি ও পিপিই'র চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পর অনেক দেশই নিজদেশে এসব পণ্য সরবরাহ বজায় রাখতে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা ও বিধি-নিষেধ আরোপ করে। ধনী দেশগুলো আগেই ভ্যাকসিন মজুদ করার চেষ্টা করবে, শুরু হবে ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ, এবিষয়টিও অনুমেয় ছিল।
তবে একটি বিষয় পরিষ্কার, বৈশ্বিক এ দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে দিনশেষে বৈশ্বিক প্রচেষ্টা ও সমাধান প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সহযোগিতার ওপর ভিত্তি করে সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বয় প্রয়োজন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বুঝতে পেরেছিলেন যে এ প্রক্রিয়ায় তার দেশ ভিন্ন ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে।
ভারত ইতোমধ্যেই বিশ্বের ফার্মেসি হিসেবে পরিচিত। দেশটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ জেনেরিক ঔষধ উৎপাদনকারী, বিশ্বের মোট ২০ শতাংশ জেনেরিক ঔষধই উৎপন্ন হয় ভারতে। বিশ্বের ৬২ শতাংশ ভ্যাকসিনের চাহিদাও মেটায় ভারত। করোনাভাইরাস মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকেই অন্য দেশগুলোর কাছে প্রয়োজনীয় ওষুধ বিক্রি করছে দেশটি। ভারত প্রায় ১০০টি দেশ থেকে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ও প্যারাসিটামল বিক্রির অনুরোধ পায়। ২০২০ সালে মে'র মধ্যেই টেস্ট কিট ও অন্যান্য মেডিক্যাল সরঞ্জামাদির ক্ষেত্রে ১৬ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে, বিক্রি করে প্রায় ৯০টি দেশে।
কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি আইনও সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয় যাতে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের সাথে সাথে ভ্যাকসিন তৈরি সম্ভব হয়। ভ্যাকসিন বৈশ্বিক সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি কার্যক্রমেও অর্থায়ন করে। নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ভারত এমাসেই বিশ্বের সর্ববৃহৎ টিকাদান কর্মসূচী শুরু করেছে। জাইডাস, ভারত বায়োটেক ও জেনোভার মতো কোম্পানিগুলো নিজেরাই ভ্যাকসিন প্রস্তুত করছে। সেরাম ইনস্টিটিউট অ্যাস্ট্রাজেনেকার সাথে চুক্তি করেছে। সেরাম ইনস্টিটিউট অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন উৎপাদন করছে, ভারত বায়োটেক নিজদের তৈরি কোভ্যাকসিন উৎপাদন করছে।
দেশটির নিজ জনসংখ্যার জন্যই ভ্যাকসিন প্রয়োজন ১ বিলিয়নেরও বেশি। তা সত্ত্বেও প্রতিবেশী দেশ নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, সিচিলিস ও মরিশাসে ২ কোটি ডোজ সরবরাহের পরিকল্পনা করছে। প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভ্যাকসিন সরবরাহ শেষ হলেই লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকার দেশগুলো ও রাশিয়ায় ভ্যাকসিন সরবরাহ করবে ভারত। অনেক দেশই ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য ভারতের সাথে জিটুজি চুক্তি (সরকারের সাথে সরকারের চুক্তি) করছে। মার্চ থেকে বাণিজ্যিকভাবে ভ্যাকসিন সরবরাহ শুরু হতে পারে। দেশটি ইতোমধ্যেই উপহারস্বরূপ বাংলাদেশ, নেপাল, ভূটান ও মালদ্বীপে মোট ৩২ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পাঠিয়েছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী নিজ দেশে আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন সকল শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হলে, অন্যত্র ভ্যাকসিন সরবরাহের জন্য রাজনৈতিক সমালোচনার মুখে পড়তে পারেন নরেন্দ্র মোদি। তবে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক প্রভাবই পড়বে। গত বছরের বিতর্কিত নাগরিক আইন ও বাংলাদেশে চীনের ৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের খবরে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কে কিছুটা ভাটা পড়ে। বর্তমানে বাংলাদেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নতির চেষ্টায় আছে ভারত। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সরবরাহ দুটি দেশের সম্পর্ক আগের চেয়ে অনেকটাই সহজ করে দিতে পারে। একইভাবে, কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সরবরাহ ভারতের নেপালের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নেরও একটি বড় সুযোগ। চীন-নেপাল-ভারত সীমান্তে অবস্থিত কালাপানি সীমান্ত বিরোধ নিয়ে দেশ দুটির মধ্যে সম্প্রতিই উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। মালদ্বীপ ও মরিশাসের মতো দেশগুলোতে ভারতের ভ্যাকসিন কূটনীতির ফলে ভারত মহাসাগর অঞ্চলে সম্পর্ক জোরদার হবে। পাশাপাশি এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও সামাজিক উন্নয়নমূলক প্রকল্পের মাধ্যমে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের সাথে পাল্লা দেয়ার সুযোগও তৈরি হলো।
ভারতের ভ্যাকসিন কূটনীতির সাথে প্রতিযোগিতায় আছে চীনও- নিজেদের ভূরাজনৈতিক সুবিধা বিবেচনায় ভ্যাকসিন সরবরাহের কৌশলের ব্যাপারে কোনো রাখঢাক রাখেনি চীন। 'হেলথ সিল্ক রোড' উদ্যোগে ভ্যাকসিন সরবরাহ করেছে দেশটি।
ভ্যাকসিন উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে চীনের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে আছে ভারত, তা সত্ত্বেও দেশ দুটির প্রতিযোগীতা খুব একটা সহজ হবেনা। ভ্যাকসিন ট্রায়ালের পরীক্ষার ফলাফলের ব্যাপারে ধোঁয়াশার কারণে চীনা ভ্যাকসিনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। সম্প্রতিই জানা গেছে, চীনের সিনোভ্যাক ভ্যাকসিন কেনার জন্য পরিকল্পনার পরও ব্রাজিল ভ্যাকসিনের স্বচ্ছতার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং ভারতের ভারত বায়োটেকের ভ্যাকসিন কেনার পরিকল্পনা করছে। এধরনের ঘটনার ফলে বৈশ্বিক ক্ষমতায় এগিয়ে যাওয়াটা সহজ হবে ভারতেও জন্য। সহজ ভাবে বলতে গেলে, বিশ্বজুড়ে, বিশেষত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের দেশগুলোতে ঔষধ ও ভ্যাকসিন সরবরাহের দীর্ঘদিনের ইতিহাস রয়েছে ভারতের।
তবে অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে অনেক বড় সুবিধা রয়েছে চীনের, দেশটি অল্প সময়েই নিজদেশের ভেতর মহামারি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। দেশটির অর্থনীতির গতিও আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে প্রায়। অর্থাৎ, বৈশ্বিক ভ্যাকসিন সরবরাহের ক্ষেত্রে চীন আরও বেশি কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে পারবে এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদিও আছে যথেষ্ট পরিমাণে। তবে, চীনের ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে আলাভাবে কিছু স্বচ্ছতার প্রশ্নও উঠতে পারে। ব্রাজিলের ঘটনাই তার প্রমাণ।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম আবিষ্কার ভ্যাকসিন। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত দেশগুলোতে ভ্যাকসিনের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পূর্ববর্তী মহামারির সময়ে, উদাহরণস্বরূপ এইচ১এন১ ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়িয়ে পড়ার সময় অনেক উন্নয়নশীল দেশই হন্য হয়ে ভ্যাকসিনের খোঁজ চালাচ্ছিল। বিশ্বজুড়ে ভ্যাকসিন সরবরাহের ক্ষেত্রে গুরূত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সময় এসেছে ভারতের।
- সূত্র: ফরেন পলিসি