প্রযুক্তিতে স্বনির্ভর হতে চীনের গোপন পরিকল্পনা
বিদেশি প্রযুক্তির ওপর চীনের নির্ভরশীলতা কমাতে গোপনে কাজ করছেন একদল বিশেষজ্ঞ। তাদের সম্পর্কে খুব কমই আলোচনা হয়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিতে চীনকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলাই তাদের মূল উদ্দেশ্য, যা সফল হলে দ্রুত বিকাশমান বৈশ্বিক খাতের সঙ্গে চীন যেভাবে প্রতিযোগিতা করে তার গতিপ্রকৃতি আমূল বদলে যাবে। বাড়বে দেশটির বাজার আধিপত্য।
বিশেষজ্ঞ দলটি দেশটির সর্বোচ্চ পর্যায়ের জাতীয় পরামর্শক গ্রুপ- ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অ্যাডভাইজরি কমিটি (এনএসটিএসি)। ২০১৯ সালে এটি গঠিত হলেও এর অস্তিত্ব দুই বছর গোপন রেখে, চলতি বছরে এসে ঘোষণা করা হয়।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, সম্প্রতি এই কমিটি 'অতি গোপনীয়' এক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেখানে রয়েছে প্রযুক্তি স্বনির্ভরতা অর্জনে বিভিন্ন সুপারিশ। চীনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এখন সে অনুসারেই নির্দেশনা দিচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শপথ গ্রহণের দুই সপ্তাহ পর, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম এ কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। সিদ্ধান্তটি যে সঠিক ছিল, তার প্রমাণ দেয় ট্রাম্পের পরবর্তী কর্মকাণ্ড। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে চীনের হুয়াওয়ে এবং জেটিই কোম্পানির পণ্য ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেন। একইসঙ্গে, চীনে উন্নত কম্পিউটিং চিপ রপ্তানি সীমিত করে তার প্রশাসন।
আনুষ্ঠানিক রূপ পায় চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রযুক্তিযুদ্ধ। চীনে শিল্পের বিকাশ অত্যাধুনিক সেমিকন্ডাক্টর চিপ সরবরাহের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। এখাতে যুক্তরাষ্ট্রসহ তার এশীয় মিত্র তাইওয়ান, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া অনেক এগিয়ে রয়েছে। তাই ট্রাম্পের এই সরবরাহ সীমিত করার উদ্যোগে বড় হুমকির মুখে পড়ে চীনের প্রযুক্তি খাত। যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুতামূলক আচরণে চিপসহ গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ না পাওয়ার কী প্রভাব পড়ছে এবং তা কাটিয়ে ওঠার উপায় খুঁজতেই এনএসটিএসি গঠিত হয় বলে গবেষক ও পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।
নিজস্ব সম্পদ কাজে লাগিয়ে সামরিক প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি কোম্পানির বিশেষজ্ঞদের মিলিতভাবে কীভাবে বৈজ্ঞানিক অর্জনে কাজে লাগানো যায় তার সেরা উপায় বাৎলে দেওয়াই এনএসটিএসির কাজ। আরেকটি দায়িত্ব, গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলো বাণিজ্যিক পণ্যে ব্যবহারের দিক-নির্দেশনামূলক পরামর্শ।
এর আগেও চীন পশ্চিমা দুনিয়ার সাথে প্রতিযোগিতার জন্য নাটকীয় পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে সব সময়েই তাতে কাঙ্খিত সফলতা পায়নি।
যেমন ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত চেয়ারম্যান মাও সেতুং তার 'গ্রেট লিপ ফরোওয়ার্ড' কর্মসূচি ঘোষণা করেন। অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের এই কর্মসূচির মূল লক্ষ্য ছিল ইস্পাত উৎপাদনে গ্রেট ব্রিটেনকে পেছনে ফেলা।
এসময় প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও জ্ঞান ছাড়াই গ্রামে গ্রামে সাধারণ মানুষকে ইস্পাত উৎপাদনে উৎসাহ দেওয়া হয়। গ্রামীণ শ্রেণির মানুষ নিজেরাই চুল্লি বানিয়ে ইস্পাত উৎপাদন শুরু করে। ফলে জ্বালানি ও ধাতুর বিপুল অপচয় হয়। এতে চাষাবাদ অবহেলিত হওয়ায় দেশজুড়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
অবশেষে বড় শিল্প-কারখানায় কেন্দ্রিয়ভাবে ইস্পাত উৎপাদনের গুরুত্ব বুঝতে পারে চীন। এবং পরের ১৫ বছরে ইস্পাত উৎপাদনে গ্রেট ব্রিটেনকে ছাড়িয়ে যায় এবং ৫০ বছরের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষতা অর্জন করে।
কিন্তু, প্রযুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত আজকের চীনের হাতে নষ্ট করার মতো সময়ের বড় অভাব। তাছাড়া, সম্পদের অপচয় কেই বা চায়। অর্থনীতিকে চাঙ্গা রেখেই দেশটিকে প্রযুক্তি স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হবে।
এজন্য সঠিক পরিকল্পনাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন শি জিনপিং। আর তেমন সঠিক উদাহরণও রয়েছে দেশটির সামনে।
যেমন ১৯৮৬ সালের মার্চে বিজ্ঞানীদের পরামর্শে '৮৬৩ প্রোগ্রাম' শীর্ষক বিজ্ঞান ও উন্নয়ন পরিকল্পনা নেন দেং জিয়াওপিং।
প্রাথমিকভাবে এই কর্মসূচির আওতায় – জৈবপ্রযুক্তি, মহাকাশ, তথ্যপ্রযুক্তি, লেজার প্রযুক্তি, অটোমেশন, জ্বালানি এবং নতুন ধাতু এই সাতটি খাতে বড় অর্জনের লক্ষ্য নেওয়া হয়। ১৯৯২ সালে এই কর্মসূচিতে টেলি যোগাযোগ এবং ১৯৯৬ সালে নৌপ্রযুক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
সঠিক দিকনির্দেশনা থাকায় পশ্চিমা দেশ থেকে প্রযুক্তি সংগ্রহে এ কর্মসূচি সফল ভূমিকা রাখে। একইসঙ্গে, চীনে উৎপাদিত পণের মান ও পরিমাণ বিপুল অগ্রগতি লাভ করে।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের এসব প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে কঠোর সমালোচনা করছে পশ্চিমা বিশ্ব। ২০১৬ সালের জুনে মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় হুয়াওয়ে টেকনোলজিসকে নোটিশ দেয়। ওই নোটিশে প্রতিষ্ঠানটি কিউবা, ইরান, উত্তর কোরিয়া এবং সিরিয়ার কাছে যেসব মার্কিন প্রযুক্তি পুনঃরপ্তানি করেছে তার তালিকা চাওয়া হয়।
এটাই ছিল, আসন্ন বিপদের পদধব্বনি। এরপরই ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় সংস্কার কমিশনের ৩২তম বৈঠকে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি অর্জনে নতুন জাতীয় পরামর্শক কমিটি গঠনের কথা জানান শি জিনপিং।
সে সময় তিনি বলেছিলেন, এ কমিটি সামরিক ও বেসামরিক খাতে ব্যবহারের জন্য মৌলিক প্রযুক্তি উন্নয়নে পরামর্শ দেবে।
এরপর ২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর চীনা সমাজতন্ত্রী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির পলিটব্যুরোকে শি জিনপিং জানান, ২০১৯ সালে গঠিত সেই কমিটি সম্প্রতি প্রযুক্তিগত বিকাশ, মানবসম্পদ পরিকল্পনা, কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জন এবং মহামারি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরামর্শ দিয়েছে। বৈঠকে এনএসটিএসি'র দেওয়া প্রতিবেদন নিয়েও আলোচনা হয়।
পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদনটি এখনও সর্ব-সাধারণের প্রকাশিত না হলেও, চীনের অনেক একাডেমিক এর আগে কমিটির মূল মিশন এবং প্রযুক্তি বিষয়ক পরামর্শক ব্যবস্থা ব্যাখ্যা করেছেন।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্স এর ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের গবেষক ওয়ান জিংগো বলেন, "আমাদের পরামর্শক পদ্ধতির মূল লক্ষ্য দুটি। প্রথমটি হলো- সর্বাধুনিক প্রযুক্তির বিষয়ে পূর্বাভাস দান। আর দ্বিতীয়টি হলো- চীনের সকল চাহিদা পূরণ করবে এমন প্রযুক্তি উন্নয়নে পরামর্শ, এরমধ্যে জনগণের জীবনমান উন্নতকরণ থেকে শুরু করে জাতীয় নিরাপত্তা সুদৃঢ় করার মতো দিকগুলি রয়েছে।"
ওয়ান আরও জানান, চীন সফলভাবে বৈশ্বিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও উদ্ভাবন প্রবণতার দিকে লক্ষ্য রাখছে এবং সেভাবেই স্থানীয় বিজ্ঞানীদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাসহ প্রযুক্তিতে বিশ্ব নেতৃত্বদানে কমিটি গঠন করাকে 'সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ' বলে উল্লেখ করেন তিনি।
চীনের আরেকজন গবেষক দাই তাও বলেন, "দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়নের গুরুত্বকে স্পষ্ট করেছে। এজন্য বেশিরভাগ উন্নত দেশই পরামর্শক ব্যবস্থা তৈরি করেছে। বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে চীনকেও তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।"
- সূত্র: এশিয়ান টাইমস