দুই মাসে দক্ষিণ আফ্রিকায় ১০ বাংলাদেশি খুন
দক্ষিণ আফ্রিকায় গত নভেম্বর মাসে বিভিন্নভাবে সাত বাংলাদেশি অপমৃত্যুর শিকার হয়েছেন। চলতি বছরের অক্টোবর মাসে খুনের শিকার হয়েছিলেন আরও তিন বাংলাদেশি নাগরিক।
মাসের পর মাস বাংলাদেশীরা নির্বিচারে হত্যার শিকার হয়ে আসলেও নিহতদের পক্ষে নিয়ে কেউ আইনিভাবে উদ্যোগী না হওয়ায় বিচার বা ক্ষতিপূরণ পাওয়ায় কোন রেকর্ড জানা নেই কারোই। বাদী, সাক্ষ্য ও তথ্য নিয়ে প্রবাসীদের মধ্যে ভীতি ছড়ানোয় তারা সহযোগীতা না করায় দূতাবাসের চেষ্টা বার বার বিফলে যাচ্ছে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, আফগানিস্তান, চীনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, জাতি গোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করলেও বাংলাদেশিরাই বেশি পরিমাণে অপমৃত্যুর শিকার হচ্ছে।
২৪ নভেম্বর (মঙ্গলবার) রাত নয়টার দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার ফ্রি স্টেট প্রদেশের জাস্ট্রন নামে এলাকায় কৃষাঙ্গ সশস্ত্র যুবকরা বাংলাদেশি সজল মিয়ার দোকানে ঢুকে তাকে গুলি করে হত্যা করে। নিহত সজল মিয়ার বাড়ি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জের উপজেলায়।
২০ নভেম্বর (শুক্রবার) রাতে দেশটির ইস্টার্ন কেপ প্রদেশের আইডুসা গ্রামে বাংলাদেশি মালিকানাধীন দোকানে গভীর রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় অন্য কর্মচারী আফ্রিকার মালাওয় নাগরিকের হাতুড়ির আঘাতে নিহত হয় বাংলাদেশি জাহিদ হাসান জিতু। তার বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলায়।
১৭ নভেম্বর (মঙ্গলবার) দক্ষিণ আফ্রিকার নর্থ ওয়েস্ট প্রদেশের মাফিকিং শহর থেকে প্রায় সত্তর কিলোমিটার দূরে মারেসানি এলাকায় ভাড়া করা সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে ঘটনাস্থলে মারা যান দুই বাংলাদেশি ইমন আহামেদ (৩২) ও আব্দুর রহমান (৩০)। একই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছে রুবেল হোসেন (২৮) নামে একজন। তিনি এখনো চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন।
নিহতদের মধ্যে আব্দুর রহমানের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার আমজানখোর কাশিবাড়ীতে এবং ইমন হোসেনের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েত পাড়ার সাতিয়ান।
১৩ নভেম্বর (শুক্রবার) রাতে সাতটার সময় দক্ষিণ আফ্রিকার ইস্টার্ন কেপ প্রদেশের আমটাটা লিবোডি নামক এলাকায় ডাকাতের গুলিতে খুন হন আরেক বাংলাদেশী ব্যবসায়ী লাভলু। তার দেশের বাড়ি জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জে।
৬ নভেম্বর (শুক্রবার) রাত সাড়ে সাতটার সময় দক্ষিণ আফ্রিকার ফ্রি-স্টেট প্রদেশের জাস্ট্রন এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে মারা যান বাংলাদেশি হারুন রাহাত। তার বাড়ি নোয়াখালী জেলার মাইজদী এলাকায়।
২ নভেম্বর (সোমাবার) রাত সাড়ে বারোটার সময় ফ্রী স্টেইট প্রদেশের পির্টাসবার্গ এলাকায় নিজ দোকান থেকে ডেকে নিয়ে অস্ত্রধারীরা বাংলাদেশি ফারুক হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে চলে যায়। নিহত ফারুকের বাড়ি বরিশালে।
আগস্ট মাস থেকে চার বাংলাদেশি নিখোঁজ
চলতি বছরের ২৯ আগস্ট দেশটির ফ্রি স্টেইট প্রদেশের উইনবার্গ থেকে একসাথে দোকানের মালামাল কিনার জন্যে বের হয়ে একটি গাড়িসহ চার বাংলাদেশি নিখোঁজ হন।
নিখোঁজরা হলেন, নোয়াখালীর সাইফুল ইসলাম পলাশ ও ফরহাদ আহাম্মেদ, মুহাম্মদ মহসিন ও সিলেটের বাসিন্দা রাসেল আহাম্মেদ।
দেশটিতে প্রবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে অপহরণের শিকার হয়ে মোটা অংকের মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া হলেও কেউ মুখ খোলে না। ফলে নেওয়া যায় না আইনী ব্যবস্থা।
দক্ষিণ আফ্রিকায় এতো প্রবাসীর প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও পর্যাপ্ত স্বাক্ষ প্রমাণের অভাবে অভিযুক্তদের বিচার হয় না তেমন। অভিযুক্ত অনেক অপরাধীই জামিনে নিয়ে মুক্ত জীবনযাপন করছে।
প্রবাসীরা জানান, বাংলাদেশিদের এই দুর্বলতার কারণে এখন বাংলাদেশিদের মধ্যেই অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে। বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ডের পেছনেই ব্যবসায়িক দ্বন্দ জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশিরাই সন্ত্রাসী ভাড়া করে একে অন্যকে খুন করাচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন প্রবাসী বলেন, বাংলাদেশিদের মধ্যে যারা অপরাধপ্রবণ তাদের অনেকেই মাফিয়া সংস্কৃতিতে জড়িয়ে গেছে। এরা নিজেদের মধ্যে ব্যবসা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ সন্ত্রাসীদের ব্যবহার বা ভাড়া করে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে যাচ্ছে।
তারা আরও বলেন, এসব অপমৃত্যুর সঠিক তদন্ত হলে অনেক বাংলাদেশিই ফেঁসে যাবেন।
এ বিষয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবাসীদের সংগঠন বাংলাদেশ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুমিনুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বাংলাদেশি কর্তৃক বাংলাদেশিদের খুনোখুনি বন্ধ করা যাচ্ছে না। দূতাবাস সবাইকে নিয়ে কাজ করলে এ ধরনের ঘটনা বড় কিছু ঘটে যাওয়ার আগে সমাধান করা সম্ভব হবে। দেশটিতে বাংলাদেশিদের মধ্যে একটি অংশ লাগামহীন হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর খালেদা আক্তার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি প্রবাসীদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে। এজন্য কমিউনিটিকে এগিয়ে আসতে হবে। নিরাপত্তার কথা সবার আগে মাথায় রাখতে হবে।
বাংলাদেশিদের অপরাধ প্রবণতার বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, নিজেদের মধ্যে এভাবে একটা পর একটা খুনাখুনি হতে থাকলে, একটা সময় দেখা যাবে বিরক্ত হয়ে সরকার সবাইকে দেশ থেকে বের দেবে।