দাবা চ্যাম্পিয়ন থেকে ভারতের সর্বকনিষ্ঠ বিলিয়নিয়ার হয়ে ওঠার গল্প
ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সে হালের জনপ্রিয় সিরিজ 'দ্য কুইনস গ্যাম্বিট' নতুন করে আবারও সাধারণের মনে দাবার উন্মাদনা জাগিয়েছে কিন্তু ভারতের ব্যাঙ্গালুরের নিখিল কামাথের মনে দাবার প্রতি অনুরাগ ছিল সেই ছোট্টবেলা থেকে।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে হাইস্কুলের পাঠ অসমাপ্ত রেখে নিজেকে পুরোপুরি দাবা খেলায় নিয়োজিত করেন নিখিল।
সিএনবিসি মেক ইটকে চতুরঙ্গে মুগ্ধ নিখিল জানান, "দাবায় আপনাকে একটি প্রক্রিয়ার ভিতরে, একটি কাঠামোর অধীনে থাকতে হয়, তবু সেখানে সৃজনশীলতার সুযোগ থাকে"।
'দ্য ওপেনিং মুভ'
এখন এই দাবা খেলুড়ে নিখিলেরই আরেকটি বড় পরিচয়, মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তিনি ভারতের সবচেয়ে বড় ট্রেডিং ব্রোকারেজ জিরোধার সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা।
মহামারী চলাকালীনও ভারতীয় স্টকগুলোতে ক্রেতাদের উপস্থিতির ঘাটতি না হওয়ায় এই প্ল্যাটফর্মটি বর্তমানে ভারতের ১৫% খুচরা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
দাবার গুটি চালার ফাঁকেই হাইস্কুল 'ড্রপ আউট' নিখিলের ব্যবসায় হাতেখড়ি মাত্র ১৭ বছর বয়সে। তবে এটা যে খুব ছক কষে হয়নি তা জানালেন নিখিল। দাবাকে ভালবাসলেও একে ঠিক ক্যারিয়ার হিসেবে নেবেন কিনা তা নিয়ে ছিল খানিকটা সংশয়। বড় ভাই নিতিনের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আস্তে আস্তে স্টক ব্যবসায়ের কৌশলগুলো আয়ত্তে আনতে লাগলেন তাই।
নিখিল বলেন, "কলেজের ডিগ্রি ছাড়া আমাকে কেউ চাকরি দিত না, ফলে আমাকে এমন একটি পথ বেছে নিতে হতো যেখানে ডিগ্রির প্রয়োজন হয় না"।
দু'ভাইয়ের মিলিত এই ব্যবসা ভালই চলছিল- কিন্তু তাদের কাছে একসময় স্টকের পুরো সিস্টেমটি জটিল লাগতে শুরু করল।
"আমি আজ থেকে ১১ কি ১২ বছর আগের কথা বলছি, সে সময় সবকিছুর দাম অনেক বেশি ছিল। ভারতে তখন ব্রোকারেজ ফী এর উচ্চমূল্য। আর সে সিস্টেমের ভেতরে থেকে একজন ফুল টাইম ব্যবসায়ীর মুনাফা লাভ করার আগে অনেকগুলো প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যেতে হতো"।
অন্যদের মত একই স্রোতে গা না ভাসিয়ে দুই ভাই মিলে ব্যবসায় নিজেদের মত করে নতুন নীতি গ্রহণ করা শুরু করলেন। নিজেদের সঞ্চয় থেকেই তারা অন্যান্য বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি সহজ এবং সাশ্রয়ী মূল্যের ব্রোকারেজ প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুললেন।
এরপরের খেলা বাজারে
২০১০ সালে তারা 'জিরোধা' প্রতিষ্ঠা করেন। শব্দটি 'জিরো' (শূন্য) এবং সংস্কৃত শব্দ 'রোধা' (বাঁধা) এর সমন্বয়ে গঠিত।
এখন পর্যন্ত কোম্পানিটি বাইরে থেকে কোন বিনিয়োগ গ্রহণ করে নি-যা জিরোধাকে অন্যান্য স্টার্ট আপের চাইতে ব্যতিক্রম করে তুলেছে।
নিখিল বলেন, "অন্য কোম্পানিগুলোর চেয়ে আমরা আলাদা ছিলাম, আমরা কখনোই বাইরে থেকে বিনিয়োগকারী বা ঋণ গ্রহণ করি নি কিংবা সত্যিকার অর্থে আমরা সেভাবে মূলধনও গড়ে তুলি নি। প্রথম থেকেই আমাদের নীতি ছিল উন্নতমানের পণ্য তৈরি করা এবং আমরা বিশ্বাস করতাম যে, আমাদের কথাতেই, আমাদের প্রতি বিশ্বাস থেকে অন্যান্য গ্রাহক কাছে আসবে"।
তারপর থেকেই, স্বর্ণ ও সম্পত্তি খাতে বিনিয়োগ ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য জিরোধার চাহিদা ভারতে ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়। মহামারীর পর পরিস্থিতি আরও বদলে যায়। লকডাউনের সময় কোম্পানিটির নিবন্ধিত গ্রাহকের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বৃদ্ধি পেয়ে ৪ মিলিয়নের ওপর ছাড়িয়ে যায়।
"অবাক করা ব্যাপার হলো, মহামারী আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। মানুষ ঘরে অলস, বন্দী সময় কাটাচ্ছিল এবং অনেকের জন্যই সে সময় বিকল্প একটি আয়ের উৎস থাকাটা জরুরী হয়ে পড়েছিল", বলেন নিখিল।
চেকমেট
২০২০ সালে, জিরোধা প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারী বিনিয়োগকারীদের গড় বয়স ৩২ থেকে ৩০ এ নেমে আসে। এর আগে মার্কিন ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম 'রবিনহুডের' ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার দেখা গিয়েছিল। অর্থাৎ সেখানেও মহামারীকালীন গ্রাহকদের বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। জিরোধাকে তাই অনেকেই রবিনহুডের ভারতীয় সংস্করণ ভাবতে শুরু করেছেন।
ভারতের এই ক্রমবর্ধমান বাজার ভবিষ্যতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিস্তারের পথ প্রশস্ত করতে পারে বলে নিখিল আশাবাদী।
"আমরা তাদের বাজার ছোঁয়ার চেষ্টা করব এবং দেখব আমাদের পণ্যের সাথে সেখানকার পণ্যের মাঝে কোন যোগসূত্র স্থাপন করা যায় কিনা"।
অবশেষে ২০২০ সালের অক্টোবরে ১৫০ কোটি ডলার সম্পদ নিয়ে কামাথ-ভ্রাতৃদ্বয় 'ফোর্বস ইন্ডিয়া রিচ লিস্টে' নাম লেখান । ফলে নিখিলের নাম চলে আসে ভারতের সর্বকনিষ্ঠ ধনকুবেরের তালিকায়।
তিনি বলেন, "টাকা কামানোটাই কখনো জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হতে পারে না; হওয়া উচিতও নয়। তবে এটা সত্যি যে, আপনার হাতে যখন মূলধন থাকবে সেটি আপনাকে বৃত্তের বাইরে গিয়ে নতুন নতুন আইডিয়া চেখে দেখার অনুপ্রেরণা জোগাবে"।