টিকা নেওয়া ব্যক্তির মৃত্যুর অর্থ এই নয় যে টিকা অকার্যকর
সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল সোমবার কোভিড-১৯ জটিলতায় মারা গেছেন। পরিবার সূত্রে জানা যায়, তিনি করোনাভাইরাসের টিকার পূর্ণ ডোজই নিয়েছিলেন। ৮৪ বছর বয়সী পাওয়েল করোনা জটিলতা ছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে ব্লাড ক্যানসারসহ আরও নানাধরনের শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন।
পাওয়েলের মৃত্যুর ঘটনায় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, টিকাবিরোধীরা হয়তো এই মৃত্যুকে ইস্যু বানিয়ে দাবি করে বসবেন, 'টিকা কাজ করে না'। করোনাভাইরাসের টিকা নেওয়ার পরেও যদি আপনি মারা যান, তাহলে টিকা নিয়ে লাভ কী?
এই প্রশ্নের উত্তরের খোঁজেই সিএনএন কথা বলেছে চিকিৎসা বিশ্লেষক ড. লিয়ানা ওয়েনের সঙ্গে। ড. ওয়েন জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি মিলকেন ইনস্টিটিউট স্কুল অফ পাবলিক হেলথের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যনীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক।
সিএনএন: পূর্ণ ডোজ টিকা নেওয়া ব্যক্তিরাও যখন কোভিড-১৯-এ মারা যাচ্ছে, তখন আপনি টিকার প্রয়োজনীয়তাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
ড. ওয়েন: বিজ্ঞান এবং গবেষণা আমাদেরকে যা দেখায় তা দিয়েই শুরু করতে হবে। কোভিড-১৯ টিকা মূলত গুরুতর অসুস্থতা এবং বিশেষ করে মারাত্মক রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অসাধারণ কার্যকরী। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, টিকা না নেওয়া একজন ব্যক্তির তুলনায় টিকা নেওয়া ব্যক্তির কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছয়গুণ কম এবং মৃত্যুর সম্ভাবনা কম প্রায় এগারো গুণ।
এর অর্থ হলো, আপনি যদি টিকা নেন, তবে টিকা নেয়নি এমন একজন ব্যক্তির তুলনায় আপনার কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছয়গুণ কমে যাবে এবং মৃত্যুর সম্ভাবনা কমবে এগারো গুণ। এটা সত্যিই চমৎকার।
যাহোক, কোভিড-১৯ টিকা আপনাকে শতভাগ সুরক্ষা দেবেনা। কোনো টিকাই তা দেয় না; এমনকি সম্ভবত পৃথিবীর কোনো চিকিৎসাই শতভাগ কার্যকর নয়। তবে এর অর্থ এই নয় যে, টিকা কাজ করে না, কিংবা এটি নেওয়া উচিত নয়।
সিএনএন: টিকা নেওয়ার পরেও কি কিছু মানুষ কোভিড-১৯ জটিলতায় গুরুতরভাবে অসুস্থ হতে পারে?
ড. ওয়েন: হ্যাঁ, অবশ্যই হতে পারে এবং যা বোঝা যাচ্ছে, জেনারেল পাওয়েল সেই শ্রেণিতেই পড়েছিলেন। আমরা এটা জানি যে, বয়স্ক ব্যক্তিদের যারা ইতোমধ্যে নানা ধরনের শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন, তাদের কোভিড-১৯ এ সংক্রমিত হওয়া, গুরুতর অসুস্থ হওয়া এবং এমনকি মারা যাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। বিশেষ করে যারা ইমিউনোকম্প্রোমাইজড, তারা রয়েছেন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। আগে থেকেই শারীরিক জটিলতা থাকায় জেনারেল পাওয়েলকে এই শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং তার বয়সও ঝুঁকির মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল।
মনে রাখবেন, মূলত এ কারণেই বুস্টার ডোজের সুপারিশ করা হয়েছে। আগস্টে, ফেডারেল স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা সুপারিশ করেছিলেন, ইমিউনোকম্প্রোমাইজড ব্যক্তিরা, অর্থাৎ বয়সের কারণে বা অন্য কোনো শারীরিক জটিলতায় যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদেরকে যেন তৃতীয় ডোজ বা বুস্টার ডোজ টিকা দেওয়া হয়। এমনকি বুস্টার ডোজ নেওয়ার পরেও তাদেরকে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।
সিএনএন: আপনি এর আগে বলেছিলেন সবাই যখন টিকা নেবে তখন এটি সবচেয়ে ভালো ফলাফল দেবে, তাই না?
ড. ওয়েন: ঠিক। কোভিড-১৯ টিকাকে আপনি খুব ভালো একটি রেইনকোট হিসেবে কল্পনা করুন। এটি আপনাকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে সুরক্ষা দেবে। কিন্তু যদি আপনি প্রচণ্ড বজ্রঝড়ের মুখোমুখি হন, সেইসঙ্গে একটি ঘূর্ণিঝড় আপনার দিকে ধেয়ে আসে,তবে আপনি নিশ্চিতভাবেই ভিজতে থাকবেন। এর অর্থ এই নয় আপনার রেইনকোটে কোনো ত্রুটি রয়েছে; বরং আপনি খারাপ আবহাওয়ায় পড়েই বিপদগ্রস্ত হয়েছেন, যেই বিপদে সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা রেইনকোটের নেই।
ঠিক একইভাবে, আপনি যদি অনেক ভাইরাসের আশেপাশে থাকেন, তাহলে আপনার সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। সমস্যাটি টিকার নয়; বরং আপনার চারপাশের ভাইরাসের সংখ্যার।
এ কারণেই যতটা সম্ভব মানুষকে টিকা দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এটি সংক্রমণের সামগ্রিক হার কমাবে এবং সবাইকে সুরক্ষা দেবে। আর যদি আপনি অনেক বেশি ভাইরাস সংক্রমিত এলাকায় থাকেন, তাহলে মাস্ক ব্যবহার করতে পারেন, এটি আপনার অতিরিক্ত সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।
এবং আমরা যেন ভুলে না যাই, আমাদের মধ্যে যাদের বয়স বেশি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং আগে থেকেই যারা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন, তারা রয়েছেন সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে। তাদের জন্য অবশ্যই টিকা নিশ্চিত করতে হবে।
সিডিসি গবেষণায় দেখা গেছে, সম্পূর্ণরূপে টিকা নেওয়া বয়স্কদের তুলনায়, টিকা না নেওয়া ব্যক্তিদের করোনাভাইরাস জনিত কারণে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা সতের গুণ বেশি। যারা টিকা নেওয়ার পরেও গুরুতর অসুস্থ হয়েছেন, হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বা যাদের মৃত্যু হয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে তারা বয়স্ক মানুষ বা আগে থেকেই শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন; যেমনটা আমরা আগেই আলোচনা করেছিলাম।
সিএনএন: যারা টিকা কার্যকর বলে বিশ্বাস করেন না তাদেরকে আপনি কী বার্তা দেবেন?
ড. ওয়েন: আমি তাদেরকে ওষুধের অন্যান্য দিক নিয়েও ভাবতে বলব। ধরা যাক, কারো হৃদরোগ আছে। হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য ওষুধ আছে, কিন্তু সেগুলো শতভাগ কার্যকর নয়; কোনো চিকিৎসাই শতভাগ কার্যকর নয়। রোগের তীব্রতায় কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলো এবং মারা গেলো; তার মানে এই নয় চিকিৎসাব্যবস্থা এবং ওষুধ গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।
প্রতিরোধের আরেকটি উদাহরণ এখানে ব্যবহার করা যেতে পারে। ধরা যাক, কেউ স্বাস্থ্যকর খাবার খায় এবং নিয়মিত ব্যায়াম করে, তারপরেও তার উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস হয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে, ডায়েট এবং ব্যায়াম করা ভাল নয়। এর মানে হলো, রোগ প্রতিরোধে আপনি যথাযথ নিয়মগুলো মেনে চলার পরেও রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ-এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিড -১৯ টিকা প্রথম পাঁচ মাসে ১ লাখ ৩৯ হাজারেরও বেশি মৃত্যু প্রতিরোধ করেছে। চলতি বছরের ৯ মে পর্যন্ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৫ লাখ ৭০ হাজার মানুষ কোভিড-১৯ এ মারা গেছে। টিকা ছাড়া এই মৃত্যুর সংখ্যা হতে পারতো ৭ লাখ ৯ হাজার।
মূল কথা হলো, টিকা কাজ করে। এটি রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস করে। তবে, এটি অন্যান্য চিকিৎসার মতই শতভাগ কার্যকর নয়।
সিএনএন: টিকা কি এই শীতেও ভাইরাসের পুনরুত্থান রোধ করতে পারবে?
ড. ওয়েন: হ্যাঁ; এটি খুবই ভালো খবর যে, কোভিড -১৯ সংক্রমণের সংখ্যা এই গ্রীষ্মে যথেষ্ট কমেছে; বিশেষ করে ডেল্টা ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ। তবে, সংক্রমণের আরেকটি ধাক্কা আসাও অসম্ভব কিছু নয়; যেহেতু মার্কিন জনসংখ্যার মাত্র ৫৭ শতাংশ সম্পূর্ণরূপে টিকা নিয়েছে।
আমি ডক্টর অ্যান্টনি ফাউসির সঙ্গে একটি বিষয়ে একমত। তিনি এই সপ্তাহান্তে বলেছিলেন "কোভিড সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ এখন আমাদের সামর্থ্যের মধ্যে আসতে শুরু করেছে"।
শেষ পর্যন্ত, কোভিডের ঝুঁকি কমানো এবং এই মহামারি শেষ করার জন্য আমাদের সবাইকেই টিকা নিতে হবে। এটি আমাদের এবং আমাদের চারপাশের মানুষকে রক্ষা করবে।