টিকটক যেভাবে আপনার মন বুঝতে পারে
অনলাইনে যোগাযোগের সামাজিক মাধ্যমগুলো আমাদের মনোজগতে নানান প্রভাব ফেলছে। এমনকি কিছু মাধ্যম নিজের চাইতেও ভালো করে বুঝছে আমাদের পছন্দ-অপছন্দ।
অন্তত টিকটকের ক্ষেত্রে এমন কথাই বলেছে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন।
চীনে তৈরি এ স্বল্প দৈর্ঘ্যের ভিডিও পরিবেশক অ্যাপটির জনপ্রিয়তার পেছনে অ্যালগরিদমের এই সূক্ষ্ম দক্ষতাকেই বলা হয়েছে প্রধান কারণ।
অতি-সম্প্রতি টিকটিকের ফাঁস হয়ে যাওয়া এক অভ্যন্তরীণ নথি সূত্রে জানানো হয় এ তথ্য।
নথিতে টিকটক অ্যালগরিদমের প্রধান চারটি উদ্দেশ্য এর কর্মীদের জানানো হয়। এগুলো হলো: ইউজার ভ্যালু, লং-টার্ম ইউজার ভ্যালু, ক্রিয়েটর ভ্যালু এবং প্ল্যাটফর্ম ভ্যালু। এই চারটি উদ্দেশ্য পূরণকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই তৈরি টিকটকের প্রোগ্রামিং।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন বলছে, এই বিশেষত্বের ফলেই বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিডিও অ্যাপ টিকটক এবং একইসঙ্গে সবচেয়ে আসক্তিকর। অর্থাৎ, ব্যবহারকারীরা এর মোহজাল কাটিয়ে উঠতে পারেন না সহজে।
'টিকটক অ্যালগো ১০০' নামের এই নথি প্রস্তুত করেছেন বেইজিংয়ে অবস্থিত অ্যাপটির প্রকৌশলীরা।
নথিটি পড়ার অনুমতি ছিল, কিন্তু অন্য কাউকে দেওয়া বা দেখানোর অনুমতি ছিল না- এমন এক ব্যক্তির মাধ্যমেই এটি মার্কিন দৈনিকটির হাতে আসে। নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি নথিটি শেয়ার করেন। টিকটকে প্রদর্শিত ক্ষতিকর কন্টেন্ট এর ব্যাপারে উদ্বেগ থেকেই তিনি এটি গণমাধ্যমকে জানানোর সিদ্ধান্ত নেন।
নথিটির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে কোম্পানির মুখপাত্র হিলারি ম্যাককাইডে।
তিনি জানান, নন-টেকনিক্যাল টিম সদস্যদের অ্যালগরিদম কীভাবে কাজ করে তা ব্যাখ্যা করতেই এটি প্রস্তুত করা হয়।
তবে এর মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো অ্যাপটির অনেক রহস্য উন্মোচন হয়েছে। যেমন এর যান্ত্রিক গণিতের মূলমন্ত্র কী এবং মানব মনের রহস্য সম্পর্কে কোম্পানির অর্জিত জ্ঞানই বা কতটুকু? টিকটক অ্যালগরিদম আমাদের অবসর কাটানোর পছন্দ বা আমাদের সাংস্কৃতিক ও গোপনীয় আচরণ সম্পর্কে কতটুকু ওয়াকিবহাল- তারও কিছুটা ইঙ্গিত দেয় এই নথি।
টিকটকের হাতেই আছে সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ স্বল্প দৈর্ঘ্যের ভিডিওর সমাহার। অ্যাপটির ব্যবহারকারী শত কোটির বেশি। তরুণ ও টিনএজারদের নানান ধরনের নিত্য ট্রেন্ড তুলে ধরতে প্ল্যাটফর্মটি অদ্বিতীয়। এতে অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমের মতো বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের সুবিধা দেওয়ার চেয়ে বিনোদনমূলক ভিডিও পরিবেশন বেশি গুরুত্ব পায়।
অন্যান্য ভিডিও অ্যাপ যেখানে ব্যর্থ; সেখানে টিকটকের সফলতার কারণ এতে ভিডিও তৈরির জন্য দেওয়া ফ্রি নেপথ্য সঙ্গীত, মিম বা প্রতিক্রিয়া যুক্তের সুবিধা। কন্টেট ক্রিয়েটাররা এতে সহজেই প্রতিনিয়ত নিজের পছন্দমতো নাচ-গান, কৌতুক বা পছন্দসই ভিডিও আপলোড করতে পারেন।
অপরদিকে নন-ক্রিয়েটর বা দর্শকরুপী ব্যবহারকারীর পছন্দ বুঝতেও ব্যাপক দক্ষ এর অ্যালগরিদম। আপনার পছন্দ অনুসারেই একের পর এক ভিডিও উঠে আসে স্ক্রিনে। তা সেটা মাইক্রোসফট এক্সেল ব্যবহারের টিপস হোক বা যৌনতার, আপনি ডানপন্থী রাজনীতি পছন্দ করছেন না বাম ঘরানার টিপ্পনি শুনতে চান- সব আপনার চেয়েও ভালো করে বুঝতে পারে এই অ্যালগরিদম।
মার্কিন গণমাধ্যম রিপেলার ইতঃপূর্বে টিকটক ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল- 'আমার চেয়েও ভালো করে আমার যৌন আগ্রহ সম্পর্কে জানে টিকটক'। ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে এত ভালো করে বোঝায় সেখানে ইউজাররা তাদের অবাক বিস্ময়ের কথা জানান।
কোন ধরনের পদ্ধতিতে ভিডিও রিকমেন্ড করা হয়, এর আগে তার একটি মোটামুটি রূপরেখা প্রকাশ করে টিকটক। সেখানে জানানো হয়, কোনো অ্যাকাউন্টের লাইক, কমেন্ট এবং ভিডিওর ক্যাপশন, সঙ্গীত বা হ্যাশট্যাগের ভিত্তিতে অ্যাপটি উপযুক্ত ভিডিও প্রদর্শন করে।
তবে এনিয়ে সন্তুষ্ট নন বিশেষজ্ঞরা। তাদের অনেকেই অ্যাপটির গাণিতিক যুক্তি বোঝার চেষ্টা করেছেন।
সম্প্রতি প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যম দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এনিয়ে কিছুটা ব্যাখ্যা করা হয়। প্রতিবেদনে প্রকাশ, আমরা ঠিক কতটুকু সময় কোন ধরনের ভিডিও দেখতে ব্যয় করছি- তা বোঝার ওপরই বেশি নির্ভরশীল টিকটক। সেই অনুসারেই একই ঘরানার ভিডিও একের পর এক দেখানো হয়, ফলে আপনি আরও বেশি সময় এতে ব্যয় করেন।
অনেক সময় এই প্রবণতা তরুণ ও অল্প বয়সী ইউজারকে বিপজ্জনক কন্টেন্টমুখী করে, যা তাদের শারীরিক বা মানসিক ক্ষতির কারণও হয়।
টিকটকে রয়েছে আত্মহত্যায় প্ররোচণা বা সহিংসতা উৎসাহ দেওয়া অনেক ভিডিও। এর আগে টিকটক জানিয়েছিল, তারা ব্যবহার বিধির আওতায় এ ধরনের আগ্রাসী কন্টেন্ট বন্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
তবে সম্প্রতি ফাঁস হওয়া নথিটি স্পষ্ট করেই দেখিয়েছে যে, কোম্পানির চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো- দৈনিক ইউজার বৃদ্ধি। এজন্য দুটি প্রধান সূচককে অ্যালগরিদমে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এর একটি হলো- রিটেনশন বা পুরোনো ইউজারকে ফিরিয়ে আন। দ্বিতীয়টি হলো- টাইম স্পেন্ট বা ইউজার যাতে বেশি সময় যুক্ত থাকেন তা নিশ্চিতকরণ। অর্থাৎ, অ্যাপটি আসক্তি তৈরির মধ্য দিয়ে আপনাকে সর্বোচ্চ সময় ধরে রাখতে চায়।
ইতঃপূর্বে অনেক বিশেষজ্ঞ টিকটককে সামাজিক হুমকি হিসেবে দাবি করেছেন। সাম্প্রতিক নথির তথ্য তাদের সে সন্দেহকে নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছে।
এনিয়ে প্যারিসভিত্তিক অ্যালগো ট্রান্সপারেন্সির বিশেষজ্ঞ গিউলামে চ্যাসলট বলেন, "এই ব্যবস্থার কেন্দ্রে রয়েছে ওয়াচ টাইম (ভিডিও দেখায় ব্যয় করা সময়)। মানুষ ঠিক যা চায় সেটি দেখানোর চেয়ে বরং তাদের পরের ভিডিও পর্যন্ত আসক্ত করে রাখাই টিকটক অ্যালগরিদমের কৌশল।"
চ্যাসলটের সংস্থা ইউটিউবের রিকমেন্ডেশন ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করে। প্ল্যাটফর্মটির ক্ষতিকর কন্টেন্ট শিশুদের ওপর কেমন প্রভাব ফেলছে সেটি জানাকেই বেশি গুরুত্ব দেয় তার সংস্থা। নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদক বেন স্মিথের অনুরোধে টিকটকের ফাঁস হওয়া নথি দেখেই তিনি এমন মন্তব্য করেছেন।
এনিয়ে তিনি আরও বলেন, "টিকটক অ্যালগরিদম এক কথায় আমাদের শিশুদের জীবনে পরিচালকের আসন করে নিয়েছে। শিশুরা যত ভিডিও দেখে, অ্যাপটি তাদের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে ততো ভালো করা জানার সুযোগ পাচ্ছে। ফলে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার সঙ্গীতের পছন্দ, শারীরিক আকর্ষণ বা মন ভালো না বিষণ্ণ সব জানতে পারছে। এসব তথ্য তার বিরুদ্ধেই ব্যবহারের ঝুঁকিও অত্যন্ত বেশি। অর্থাৎ, তাকে নির্দিষ্ট করে টার্গেট করে প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহারে আরও আসক্ত করে তোলা যেতে পারে।
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস