গ্রেপ্তারের পর মিয়ানমারের কবির অঙ্গপ্রত্যঙ্গবিহীন লাশ ফেরত
সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী লেখা লিখে পরিচিত মিয়ানমারের কবি খেত থি, সেনাবাহিনীর হাতে আটকাবস্থায় মারা গিয়েছেন। সেই সাথে শরীরের কিছু অংশ সরিয়ে ফেলে তার লাশ ফেরত দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে কবির পরিবার।
এব্যাপারে মন্তব্যের জন্য সামরিক জান্তার এক মুখপাত্রকে ফোন করে প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্দিয়ান, কিন্তু তিনি তাতে সাড়া দেননি। খেত থি এর লেখা একটি পঙক্তি ছিল "তারা মাথায় গুলি করেছে, কিন্তু ওরা জানা নেই বিপ্লব থাকে বুকের মধ্যে।" মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ৪৫ বছর।
খেত থি'র স্ত্রী জানান, গত শনিবার সাগাইং অঞ্চলের শেবো শহর থেকে সশস্ত্র সৈনিক ও পুলিশেরা এসে তাদের দুজনকেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধরে নিয়ে যায়। অং সান সু চি-কে উৎখাতের পর থেকে শেবো শহর সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের একটি কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
কবির স্ত্রী চাও সু বার্তা সংস্থা বিবিসির বার্মিজ ভাষা সার্ভিসকে বলেন, "আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং ওকেও । তারা আমায় বলে যে সে (খেত থি) জিজ্ঞাসাবাদ সেন্টারেই আছে। কিন্তু সে আর ফিরে আসেননি, এসেছে শুধু তার লাশ।"
চাও সু আরো বলেন, "তারা সকালবেলা আমাকে কল করে এবং মনিওয়া শহরের একটা হাসপাতালে আমার স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে বলে। আমি ভেবেছিলাম যে হয়তো তার হাড় ভেঙ্গে গেছে বা ছোটখাটো কোনো অসুস্থতা। কিন্তু আমি যখন হাসপাতালে পৌঁছলাম, তারা আমাকে মর্গে নিয়ে গেল এবং সেখানে গিয়ে দেখি যে তার দেহের ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বের করে নেয়া হয়েছে।"
হাসপাতালে চাওকে বলা হয়, তার স্বামীর হৃদযন্ত্রের অসুখ ছিল। কিন্তু চাও মৃত্যু সনদ পড়েও দেখেননি, কারণ তিনি জানতেন এই কথা সত্যি নয়। রয়টার্স হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়েও পারেনি।
চাও সু জানান, সেনাবাহিনী তাকে কবর দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু তিনি স্বামীর লাশ পাওয়ার জন্য হাতজোড় করে অনুরোধ করেন। তবে চাও বলেননি যে, তার স্বামীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রেখে দেয়া হয়েছে তা তিনি কিভাবে জানলেন।
অ্যাসিসটেন্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স নামের একটি অধিকার গোষ্ঠী জানিয়েছে, কবি খেত থি-কে জিজ্ঞাসাবাদের সময় নির্যাতন করার ফলে তিনি হাসপাতালে মারা যান। তারা এক বুলেটিনে আরো জানায়, অভ্যুত্থানের পর থেকে সেনাবাহিনী এপর্যন্ত ৭৮০ জন বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে। অবশ্য অধিকার গোষ্ঠীটি হত্যার হিসাব রাখলেও তারা তাদের তথ্যসূত্র জানায়নি।
গত ১ ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর থেকে খেত থিসহ অন্তত তিনজন কবি নিহত হয়েছেন। কবি কে জা উইন (৩৯) মার্চের শুরুর দিকে মনিওয়া শহরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
হত্যা ও হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করার পরেও মিয়ানমারের অভ্যুত্থানবিরোধী আন্দোলনে বা দৈনিক প্রতিবাদ মিছিলে সাংস্কৃতিক কর্মী ও তারকারা উল্লেখযোগ্য সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন।
২০১২ সালে চাকরি ছেড়ে দেয়ার আগপর্যন্ত খেত থি ছিলেন একজন প্রকৌশলী। এরপর থেকে তিনি সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন এবং সংসারের খরচ মেটাতে আইসক্রিম ও কেক বানিয়ে বিক্রি করতেন।
অভ্যুত্থানের দুই সপ্তাহ পর থি লিখেছিলেন, "আমি বীর হতে চাইনা, আমি শহীদ হতে চাইনা, আমি দুর্বল প্রাণী হতে চাইনা, আমি বোকা হতে চাইনা। আমি কোনো অন্যায়কে সমর্থন করতে চাই না। আমি শুধু এক মিনিটের জন্য বাঁচতে চাই, আমি শুধু আমার বিবেককে সেই এক মুহূর্তের জন্য পরিষ্কার রাখতে চাই।"
মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি ফেসবুকে লেখেন, আমি একজন গিটার বাদক, পাচক ও কবি। আমি কোনো বন্দুক চালানো যোদ্ধা নই। কিন্তু, চারপাশ দেখেশুনে নিজের চিন্তার ধরন বদলে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
তিনি লিখেন, "আমার দেশবাসীকে গুলি ছুঁড়ে হত্যা করা হচ্ছে, আর তার বদলে আমি শুধু কবিতা ছুঁড়তে পারছি। কিন্তু যখন দেখবেন আপনার প্রতিবাদী কবিতার স্বর যথেষ্ট নয়, তখন আপনাকে খুব সাবধানে বন্দুক হাতে তুলে নিতেই হবে। আমিও গুলি ছুড়বো।"
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান