কয়েক মাস, এমনকি বছরব্যাপী এয়ারপোর্টেই যাদের বাস
টানা তিন মাস শিকাগোর ও'হারে এয়ারপোর্টে কাটানোয় গত জানুয়ারিতে আদিত্য সিং নামের ৩৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। ২০২০ সালের অক্টোবর থেকেই এয়ারপোর্টে থাকা শুরু করেন তিনি। এয়ারপোর্টে আগত যাত্রীদের খাবার ও অর্থ সহায়তা নিয়ে দিন কাটতো তার। এয়ারপোর্টের এক কর্মকর্তা তাকে তার আইডি দেখাতে বলার পরই ধরা পড়ে যান তিনি।
তবে এয়ারপোর্টকেই বাসা-বাড়ি বানিয়ে নেওয়া প্রথম ব্যক্তি তিনি নন। কয়েক সপ্তাহ, মাস এমনকি কয়েক বছরও এয়ারপোর্টে দিন কাটিয়েছেন এমন ঘটনাও আছে অনেক।
ভীড়ে মিশে যাওয়া
এয়ারপোর্টে খাবার, পানি, ঘুমানোর জায়গা, শৌচাগার সবকিছুরই ব্যবস্থা থাকায় এয়ারপোর্টে দীর্ঘদিন বাস করা সম্ভব হয়। টানা ২৪ ঘণ্টা এয়ারপোর্টের সব কাজ চালু না থাকলেও, টার্মিনাল ভোরে ভোরে খুলে যায়, আবার গভীর রাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকে।
ও'হারের মতো বড় এয়ারপোর্টগুলোতে নিরাপত্তারক্ষী কর্মকর্তাদের নজর এড়িয়েই অনেকে বেশ দীর্ঘ সময় এয়ারপোর্টে দিনযাপন করেন।
শনাক্ত না হওয়ার জন্য এয়ারপোর্টের এ ধরনের বাসিন্দারা সহজেই ভীড়ে মিশে যান। যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারপোর্টগুলোতে সাধারণ সময়ে দিনে ১৫-২৫ লাখ যাত্রীর যাতায়াত থাকে।
তবে মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর এয়ারপোর্টে যাত্রীর সংখ্যা কমতে থাকে। ২০২০ এর মাঝামাঝি সময় যাত্রীসংখ্যা এক লাখেরও নিচে নেমে আসে। ২০২০ সালের অক্টোবরে যাত্রী সংখ্যা আবারও বাড়তে শুরু করার পর থাকা শুরু করেন ও'হারে এয়ারপোর্টের গ্রেপ্তার হওয়া ওই ব্যক্তি। আবারও করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়তে শুরু করার পর জানুয়ারিতে এয়ারপোর্টে যাত্রী কমে যায়, তখনই ধরা পড়ে যান তিনি।
তবে এয়ারপোর্টের টার্মিনালে দিন কাটানো অনেকে আবার নিতান্ত বাধ্য হয়ে অস্থায়ীভাবে থাকেন কিছুদিন। ঘনঘন বিমানযোগে ভ্রমণ করলে ক্যান্সেল হওয়া ফ্লাইট, প্রতিকূল আবহাওয়া, যোগাযোগ ভ্রান্তিসহ বিভিন্ন কারণে স্বল্প সময়ের জন্য এয়ারপোর্টে আটকা পড়েন।
অনেকে আছেন যারা অজান্তেই আরও দীর্ঘদিন নিজেদের এয়ারপোর্টে বসবাসরত অবস্থায় আবিষ্কার করেন। এ ধরনের ঘটনার মধ্যে বহুল প্রচলিত হলো মেহরান কারিমি নাসেরির ঘটনা। টম হ্যাংকস অভিনীত "দ্য টার্মিনাল" চলচ্চিত্রের ঘটনাও ইরানি এ শরণার্থীর জীবনের গল্প থেকে অনুপ্রাণিত।
১৯৮৮ সালে বেলজিয়াম ও ফ্রান্স হয়ে ইংল্যান্ড যাওয়ার পথে তার শরণার্থী পরিচয়ের প্রমাণপত্র হারিয়ে ফেলেন নাসেরি। কাগজপত্র ছাড়া ইংল্যান্ডের ফ্লাইটেও উঠতে পারছিলেন না, আবার প্যারিস এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে ফ্রান্সে প্রবেশের অনুমতিও পাননি। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের কর্মকর্তাদের আনুষ্ঠানিক কাজের জটিলতায় তার এয়ারপোর্টে থাকার সময় বাড়তে থাকে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে এসে ফ্রান্সের কর্তৃপক্ষ তাকে ফ্রান্সে বসবাসের অনুমতি দেয়, তবে নাসেরি তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় কারণ তার গন্তব্য ইঙ্গল্যান্ডে যেতেই বদ্ধপরিকর তিনি। তারপর থেকেই ফ্রান্সের চার্লস দে গাল এয়ারপোর্টে দীর্ঘ ১৮ বছর কাটিয়ে দেন তিনি। ২০০৬ সালে স্বাস্থ্যগত জটিলতার কারণে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পড়লে এয়ারপোর্ট ত্যাগ করেন তিনি।
কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, মৃত্যুর মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে মেহরান কারিমি নাসেরি আবারও তার পুরনো ডেরা, বিমানবন্দরেই ফিরে আসেন! সেখানেই ত্যাগ করেন তার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস।
এমনই আরেকজন এডওয়ার্ড স্নোডেন। ২০১৩ সালে রাশিয়ার এয়ারপোর্টে এক মাসেরও বেশি সময় কাতান তিনি। ২০০৪ সালে ব্রিটিশ ওভারসিজ সিটিজেন পাসপোর্টের অধিকারী সঞ্জয় শাহকে আটকে দেন ইমিগ্রেশন অফিসাররা। কেনিয়ার নাগরিকত্ব ত্যাগ করায়, তাকে কেনিয়ায় ফেরত পাঠানর পর কেনিয়ায়ও প্রবেশ করতে পারছিলেন না। এক বছর পর তিনি পূর্ণাঙ্গ ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পাওয়ার পর এয়ারপোর্ট ছেড়ে অবশেষে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান।
সম্প্রতি করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাবে অনেকেই দীর্ঘ মেয়াদে এয়ারপোর্টে থাকা শুরু করেছেন। ২০২০ সালের ২০ মার্চ ব্যাংকক থেকে মানিলা এয়ারপোর্টে পৌঁছান এস্তোনিয়ার নাগরিক রোমান ট্রফিমভ। তবে তিনি পৌঁছানোর আগেই ফিলিপাইন সংক্রমণ রোধে ভিসা প্রদান স্থগিত করে। এস্তোনিয়ার দূতাবাস ব্যবস্থা গ্রহণের আগ পর্যন্ত প্রায় ১০০ দিন এয়ারপোর্টে কাটান তিনি।
গৃহহীনদের আশ্রয়স্থল
অনেকেই পরিস্থিতির চাপে পড়ে সাময়িকভাবে এয়ারপোর্টের বাসিন্দা হয়ে উঠলেও তাদের বেশিরভাগই সুযোগ পেলেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে ইচ্ছুক। তবে অনেকেই আছেন যারা পাকাপাকিভাবে এয়ারপোর্টে আবাস তৈরি করে নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের প্রধান প্রধান এয়ারপোর্টগুলোতে গৃহহীনদের নিবাস দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে।
১৯৮৬ সালে শিকাগো ট্রিবিউনে ফ্রেড ডিলসনার নামের এক ৪৪ বছর বয়সী অ্যাকাউনট্যান্টের ব্যাপারে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তিনি এক বছর শিকাগোর ও'হারে এয়ারপোর্টে ছিলেন। প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, ১৯৮৪ সালের দিকে প্রথম গৃহহীনরা এয়ারপোর্টটিতে থাকতে শুরু করে। এয়ারপোর্টটিতে ৩০-৫০ জনের মতো মানুষের বাস ছিল সে সময়, তবে শীতের প্রকোপ বাড়লে আশ্রয়গ্রহীতার সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে যায় বলে জানিয়েছিলেন কর্মকর্তারা।
একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এ চিত্র বজায় আছে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে তাদের ওপর অতিরিক্ত স্বাস্থ্যঝুঁকিও তৈরি হয়েছে।
এয়ারপোর্টের কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময় তাদের সাহায্যের উদ্যোগ নিলেও, বলাই বাহুল্য আশ্রয়কেন্দ্রের দায়িত্ব থাকবে না এমন সমাধানই বেছে নেবেন তারা।
- সূত্র: সিএনএন