কোভিডের সম্ভাব্য চার উৎসের সন্ধান দিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) একটি খসড়া প্রতিবেদন থেকে খবর মিলেছে, প্রাণী থেকেই কোভিড-১৯ ভাইরাসের সূত্রপাত হবার সম্ভাবনা বেশি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ধরা পড়ার মাস দুয়েক আগে থেকেই এর সংক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছিল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ আন্তর্জাতিক দল জানায়, ল্যাবরেটরি লিকেজ থেকে ভাইরাস ছড়ানোর বিষয়টির সত্যতা খুবই ক্ষীণ।
সংস্থাটির কাছে শিগগিরই করোনাভাইরাসের উৎস সম্পর্কে একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। তবে এর আগেই সিএনএনের হাতে আসা এক খসড়া প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের শেষদিকের আগে ভাইরাস ছড়ানোর কোনো প্রমাণ বিজ্ঞানীরা পাননি।
প্রতিবেদনে কোভিডের সম্ভাব্য চারটি উৎসের নাম নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে জোরাল উৎস হিসেবে বলা হয়েছে, কোনো প্রাণী দেহকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে এই ভাইরাস ছড়ায়। সেটি সম্ভবত কোনো বন্যপ্রাণী ছিল, যেটি এনে একটি খামারে লালন-পালন করা হয়।
তবে ঠিক বাদুরের দেহ থেকেই এ ভাইরাস অন্য প্রাণী দেহে এবং পরে মানবদেহে সংক্রমিত হয়েছে কি না, তা এই তদন্তে বের করে আনা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ, সার্স-কোভ-২-এর মূল হোতার নামটি অধরাই থেকে গেছে।
প্রতিবেদনে পরবর্তী সম্ভাব্য উৎস হিসেবে বলা হয়, বাদুর কিংবা প্যাঙ্গোলিন জাতীয় প্রাণী হয়তো করোনাভাইরাসের বাহক। এর পরবর্তী উৎস হতে পারে ফ্রোজেন ফুড বা হিমায়িত খাদ্য। তবে দুর্ঘটনাক্রমে ল্যাবরেটরি লিকেজ থেকে ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
অবশ্য, যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের পরিচালক ডা. রবার্ট রেডফিল্ড সিএনএনের ডা. সঞ্জয় গুপ্তকে জানান, ব্যক্তিগতভাবে তিনি বিশ্বাস করেন, ভাইরাসটি চীনের ল্যাব থেকেই ছড়িয়েছে।
যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, সেটি হওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ তাদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সার্স-কোভ-২-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত কোনোকিছুর গবেষণাই ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের আগে কোনো ল্যাবে হয়নি।
এদিকে, স্বাধীন গবেষকরা একই কথা কয়েক মাস ধরেই বলে আসছিলেন। ভাইরাসের জিনোমিক টেস্টিং প্রমাণ দেয়, তা কোনো ল্যাব থেকে ছড়ায়নি, বরং প্রাণী দেহ থেকে ছড়িয়েছে, যা আগেও ২০০২-২০০৪ সালের দিকে প্রায় ৮ হাজার মানুষকে সংক্রমিত করেছিল।
তাছাড়া হিমায়িত খাদ্য থেকেও করোনাভাইরাস সংক্রমণের জোরাল কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ হয়।
ভাইরাস সংক্রমণে হুয়ানানের সীফুড মার্কেটের ভূমিকাও স্পষ্ট নয়। হতে পারে ওই মার্কেটই ভাইরাসের আসল উৎস নয়; বরং মার্কেটে আগত অগণিত লোকের গাদাগাদিতেই ভাইরাসটির সংক্রমণ ঘটে।
মার্কেটের প্রাণী বা বিক্রিত খাবারের নমুনাতে নয়, বরং জনসমাগমের মধ্যেই ভাইরাস ভেসে বেড়ানোর ঝুঁকি রয়েছে। তাছাড়া হুয়ানান মার্কেটে ছড়ানোর আগেই অন্যত্র করোনাভাইরাস ছড়ানোর প্রমাণ মিলেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, হুয়ানানের মার্কেটই আসল উৎস কি না কিংবা সেখানে কীভাবে সংক্রমণ ঘটেছে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যপ্রমাণ এই অনুসন্ধানে বের করা সম্ভব হয়নি।
প্রতিবেদনে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে করোনাভাইরাসের প্রাথমিক পর্যায়ে নেওয়া রক্তের নমুনা আরও বেশি বেশি পরীক্ষা করতে বলা হয়েছে। তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পশুগুলোর দেহে নমুনা পরীক্ষা এবং জনসমাগম গভীরভাবে পরীক্ষা করারও পরামর্শ দিয়েছেন।
চীনের ১৭ জন বিশেষজ্ঞ এবং অন্যান্য দেশের আরও ১৭ জন বিশেষজ্ঞ মিলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধীনে এই প্রতিবেদন তৈরি করেন। প্রতিবেদনটির পর্যবেক্ষক হিসেবে যুক্ত ছিল জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, প্রাথমিক অনলাইন মিটিং শেষে এ বছরের ১৪ জানুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চীনের উহানে ২৮ দিনের এই গবেষণা চালানো হয়। বিশেষজ্ঞ দল চীনে ভাইরাসের উৎপত্তি ও প্রসারের সার্বিক প্রমাণ অনুসন্ধান করেন। মহামারি বিষয়ক পর্যবেক্ষক দল নিবিড়ভাবে এই গবেষণা পর্যবেক্ষণ করেছে বলেও প্রতিবেদনে লেখা হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশেষজ্ঞরা রোগের ক্ষেত্রে ল্যাবরেটরি কনফারমেশন নিয়েছেন এবং জাতীয় পর্যায়ে নজরদারি রেখেছেন। সর্দি-কাশির মতো রোগের ক্ষেত্রে কী পরিমাণ ওষুধ কেনা হয়েছে- সেসব তথ্য এবং সেইসঙ্গে ২০১৯ সালের দ্বিতীয় ভাগে উহান ও হুবেই প্রদেশের বিভিন্ন হাসপাতালের সাড়ে ৪ হাজার গবেষণা প্রজেক্ট নমুনা সংগ্রহ করেছেন তারা। এইসব গবেষণার কোনোটিতেই কোভিড-১৯ মহামারি রূপে ছড়ানোর কয়েক মাস আগে কোনো রোগের ফলে ব্যাপক হারে মৃত্যুর প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তবে আরও বেশি উৎস সন্ধানের জন্য খামারগুলোতে পরীক্ষা চালানোর পরামর্শ দেওয়া হয় ওই প্রতিবেদনে।
সেখানে বলা হয়, 'যদিও বাদুরের মধ্যেই ভাইরাসের সঙ্গে সম্পর্কিত সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সূত্রের প্রমাণ মিলেছে, তবু এ প্রাণীর মধ্যে থাকা ভাইরাস ও সার্স-কোভ-২-এর মধ্যে কয়েক দশকের বিবর্তনিক দূরত্ব রয়েছে এবং এখানে একটি সূত্র অনুপস্থিত।'
বেজি ও খরগোশ জাতীয় প্রাণী করোনাভাইরাসের জন্য সন্দেহজনক বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। কেননা, বেশ কিছু দেশেই বেজির খামার থেকে কোভিড-১৯ ছড়িয়েছে।
যেসব খামারে ঘনবসতির মধ্যে প্রাণী লালন-পালন করা হয় এবং তাদের মধ্যে হেপাটাইটিস জাতীয় রোগের সংক্রমণ প্রায়ই ঘটে, সেসব প্রাণীকে করোনাভাইরাসের জন্যে সন্দেহজনক বলে উল্লেখ করা হয়। কারণ, সারা বিশ্বজুড়েই উচ্চ ঘনবসতির খামারের প্রচলন রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি জানিয়েছেন, সিডিসি, দ্য ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, দ্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ-সহ ফেডারেল গভর্নমেন্ট এজেন্সিগুলো এবং গণস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা শিগগিরই এই প্রতিবেদন পুনঃমূল্যায়ন করবেন।
সাকি আরও জানান, চলমান মহামারি সংকট বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে এবং তারা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিবেদনটির মূল্যায়ন করবেন।
- সূত্র: সিএনএন