কূটনীতির নতুন মাধ্যম: কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন

ভ্যাকসিন উৎপাদনের অদ্বিতীয় সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে কোভিড টিকার লাখ লাখ ডোজ বন্ধুপ্রতিম ও বিপদাপন্ন দেশকে দিচ্ছে ভারত। চীনের প্রভাব মোকাবিলা করতেই একাজ করছে দেশটি। চীনও ভ্যাকসিন প্রাপ্তির সুযোগকে তাদের কূটনীতির প্রধান অস্ত্রে রূপ দিয়েছে। অন্যদিকে, খনিজ তেল সমৃদ্ধ সংযুক্ত আরব আমিরাতও মিত্রদেশে সরবরাহের জন্যে বিপুল সংখ্যায় ডোজ কিনছে।
বিশ্বের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত পণ্য এখন করোনাভাইরাস প্রতিষেধক। আন্তর্জাতিক কূটনীতির জগতে তা সম্পর্কোন্নয়ন ও প্রভাব বিস্তারের নয়া মুদ্রা, তথা মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাকসিন উদ্ভাবন বা উৎপাদনের সক্ষমতা থাকা দেশগুলো এই দৌড়ে অগ্রগামী। যেমন; নেপালের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির পর দেশটিতে বড় আকারের চালান পাঠিয়ে নতুন উষ্ণতার জন্ম দিচ্ছে নয়াদিল্লি। ক্রমশ দেশটি বেইজিং এর নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছিল, যা নতুন আঙ্গিকে মোকাবিলার সুযোগ পাওয়া মাত্রই কাজে লাগিয়েছে ভারত।
কৌশলটিতে ঝুঁকির পরিমাণ নেহাত কম নয়। ভারত ও চীন উভয়েই উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের জন্যে টিকা উৎপাদনে জড়িত। তাদের নিজ জনসংখ্যাও বিপুল, যাদের সকলের টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
ইতোমধ্যেই, উভয় দেশে টিকা রপ্তানি ও অনুদান নিয়ে অসন্তোষ ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তাই বলা যায়, কূটনীতিক প্রচারের ডামাডোলে অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে ভবিষ্যতে বহিঃবিশ্বে সরবরাহ বন্ধ হতে পারে। সেটাই সবচেয়ে বড় ঝুঁকি।
চীনে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিপক্ষে জনমত প্রকাশের সুযোগ ভারতের তুলনায় অনেক কম। আর ভারতীয়রা এব্যাপারে একটু বেশিই সরব।
নয়াদিল্লি ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক- অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সুপরিচিত ফেলো- মনোজ জোশির কণ্ঠেই মেলে তার তিক্ত আভাস। তিনি বলেন, "ভারতীয়রা আক্রান্ত হচ্ছে, তারা মারাও পড়ছে। নিজস্ব চাহিদা পূরণ হওয়ার পর, রপ্তানি ও দানের সিদ্ধান্ত নিলে- তা বুঝতে পারতাম। কিন্তু, আমি মনে করি, আদর্শগত শ্রেষ্ঠত্বের মিথ্যে বিশ্বাসে ভর করে, সরকার আগে জনতার চাহিদা না মিটিয়ে, দেশের বাইরে সরবরাহ করছে।"

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য ধনী দেশগুলি যখন বৈশ্বিক টিকা সরবরাহের সবচেয়ে বড় অংশ মজুদ করে রেখেছে, ঠিক সেই সময়ে দানকারী দেশগুলি তাদের সাহায্য দিচ্ছে। আবার দরিদ্র দেশেরা মরিয়া নিজ চেষ্টায় ডোজের চালান যোগাড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই পরিস্থিতিকে নৈতিকতার চরম ব্যর্থতা এবং অসাম্যের চূড়ান্ত নিদর্শন বলে অবহিত করে।
জনস্বাস্থ্য খাত তীব্র চাপের মুখে থাকায় সিংহভাগ দেশ যেখান থেকে যা পাওয়া যায়, সেটাই গ্রহণ করতে উৎসাহী। তার পরিবর্তে রাজনৈতিক অভিসন্ধি পূরণের সুযোগ এসেছে টিকাদানকারী দেশগুলোর সামনে।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক- গালফ ইন্টারন্যাশনাল ফোরামের নির্বাহী পরিচালক ডানিয়া থাফের মানবিক সহযোগিতার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন, " সৈন্য পাঠিয়ে কোনো দেশ নিয়ন্ত্রণের চাইতে, আপনি চাইলেই সেদেশের মানুষের জীবন বাঁচিয়ে, টিকাদান কর্মসূচিতে সাহায্য করে লাভবান হতে পারেন। এখন সেই চর্চাই চলছে।"
কূটনীতিতে সবার আগে ভ্যাকসিন সহায়তার আঙ্গিক যুক্ত করে চীন। গেল বছরের শেষদিকে দেশটি কার্যকর প্রমাণিত একটি ভ্যাকসিন ব্যাপক মাত্রায় উৎপাদন করে, উন্নয়নশীল বিশ্বে সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেয়। চলতি সপ্তাহেই দেশটি মিশরে ৩ লাখ ডোজ দানের ঘোষণা দিয়েছে।
তবে সরবরাহ পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় এবং ফলপ্রসূতার হার নিয়ে প্রশ্ন ওঠায়; চীনের ভ্যাকসিন কূটনীতি কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের সন্দেহের মুখে হঠাৎ করে নিজ দেশে জরুরি চাহিদার কথা উল্লেখ করে, বহিঃবিশ্বে সাহায্যের গতি কমায় চীন।
ভারত পশ্চিমা বিশ্বের সুপ্রমাণিত টিকা উৎপাদনের ফর্মুলা পাওয়ায় সেদিক থেকে কোনো সমস্যায় পড়েনি। কিন্তু, জনগণের বড় অংশ এর বিরোধিতা করলে নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়তে পারে।

আপাতত, বেইজিংয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাবমুর্তি উজ্জ্বল করার দারুণ সুযোগ পেয়েছে দিল্লি। দেশটির কর্মকর্তারাও প্রতিবেশী দেশগুলোতে চালান পাঠানোর ঘোষণা দেওয়ার সময়, এই ইঙ্গিত স্পষ্টভাবেই দিয়েছিলেন।
অক্সফোর্ড- অ্যাস্ট্রাজেনেকা আবিষ্কৃত টিকার দৈনিক ২৫ লাখ ডোজ উৎপাদন করছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন কারখানা- সেরাম ইনস্টিটিউড অব ইন্ডিয়া। দ্রুতগতির কল্যাণেই প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিনামূল্যে বড় চালান পাঠানোর অবকাশ পায় ভারত। বেশ ধুমধাম করেই বিমান ভর্তি চালান পাঠানো হয়; বাংলাদেশ, নেপাল, মিয়ানমার, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, সিশেলস এবং আফগানিস্তানে।
ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের ভাষায়, "পূর্বমুখী নীতি এবং দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ," টুইটারে মিয়ানমারে চালান পৌঁছানোর খবর জানিয়ে তিনি একথাই লেখেন।
এছাড়া, সুদূর ব্রাজিল এবং মরক্কোয় চালান পাঠিয়ে ইতিবাচক প্রচারণার চেষ্টা চালায় ভারত সরকার। তবে দেশদুটি এসব চালান কিনেছিল, এবং তা কোনো দয়া-দাক্ষিণ্য ছিল না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভ্যাক্স উদ্যোগে ২০ কোটি ডোজ সরবরাহের অঙ্গীকার করেছে সেরাম ইনস্টিটিউড। এর পুরোটাই যাবে কম আয়ের দেশে। অন্যটিকে, চীন ১০ কোটি ডোজ সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
আপাতত, ভারত সরকারের সামনে দান করার সামর্থ্য আছে। সংক্রমণের কেস সংখ্যা কয়েক মাস আগে বাড়লেও, এখন তা পড়তির দিকে। তবে অর্থনীতির বেহাল দশায়, দ্রুত টিকাদান সম্পন্ন করার দাবি উঠছে বিশেষজ্ঞ মহল থেকে। মহামারি নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনীতি পুরোদমে সচল করাটাই এখন অগ্রাধিকার হওয়া উচিৎ বলে মনে করছেন তারা।
তারপরও, ভারত সামর্থ্য পেয়েছে সেরাম ইনস্টিটিউডের বিপুল উৎপাদনের কারণে। দেশটি জাতীয়ভাবে যত দ্রুত টিকা দিচ্ছে, দৈনিক উৎপাদনে সেই চাহিদা পূরণ করেও; অতিরিক্ত চালানের নিশ্চয়তা দিচ্ছে সেরাম। তাই রপ্তানিকেও বাধাগ্রস্ত করার প্রয়োজন এই মুহূর্তে নেই।

তাছাড়া, স্থানীয়ভাবে আবিষ্কৃত কোভ্যাক্সিন নামের একটি টিকার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ থাকায় অনেক ভারতীয় টিকা নিতে খুব একটা উৎসাহ পাচ্ছেন না। সরকারি নীতির আওতায় কে কোভ্যাক্সিন পাবেন আর কাকে অক্সফোর্ডের আবিষ্কৃত কোভিশিল্ড দেওয়া হবে, সেটা টিকাগ্রহীতাদের না জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এই দোটানা তৈরি হয়।
চীনের মতো শক্তিশালী অর্থনীতির দেশকে মোকাবিলায় টিকা নিয়ে রাজনীতি দিল্লির সামনে এক আশীর্বাদ। দক্ষিণ এশিয়ার নিজ প্রাঙ্গণেই গত এক দশক ধরে চীনের অব্যাহত প্রভাব বিস্তার দেখার পর; এবার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার স্বপ্নে বিভোর ভারতীয় নীতি-নির্ধারক মহল।
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস