করোনা ভাইরাস: বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত
৩১ বছর বয়স্ক চীনা প্রকৌশলী এডিসন ঝাং, উহানে এসেছিলেন চান্দ্র নববর্ষ পালন করতে। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী আর শ্বশুর-শাশুড়ি।
গত ২২ জানুয়ারি উহান থেকে নিজের শহর চংকিং এ ফেরেন তারা। পরদিনই খুশখুশে কাশি নিয়ে হাসপাতালে যান ঝাং এর শ্বশুর। তারা চাইছিলেন ন্যাসোফ্যারিঞ্জিয়াল সোয়্যাব টেস্ট করাতে, যাতে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হয়েছেন কি না বোঝা যায়।
কিন্তু চিকিৎসকরা জানিয়ে দিলেন, পর্যাপ্ত পরিমাণ টেস্টিং কিট নেই! যে দেশে করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি, সেখানেই নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা। সোমবার পর্যন্ত চীনে করোনা ভাইরাসে এক হাজার ৭৭০ জন মারা গেছে এবং ৭০ হাজার ৫৪৮ জন আক্রান্ত হয়েছে।
এতো উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি থাকা সত্ত্বেও এরকম হিমশিম খেতে হচ্ছে চীন সরকারকে। এডিসন ও তার স্বজনের মতো অসহায় অবস্থা দেশটির অন্যদেরও।
এ অবস্থায় করোনা ভাইরাস যদি বাংলাদেশে আসে তাহলে আমরা সে পরিস্থিতি কতটা সামাল দিতে পারব- তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
গত ১ ফেব্রুয়ারি চীন থেকে দেশে ফেরত এসেছেন ৩১৪ বাংলাদেশি। তাদের টঙ্গীর আশকোনা হজ ক্যাম্পে রাখা হয়। ক্যাম্পের মোট তিনটি ফ্লোরে রাখা হয় চীন ফেরত বাংলাদেশিদের।
কিন্তু ক্যাম্পের পরিবেশ দেখে তাদের অনেকেই বলেছেন, এর চেয়ে চীনে থাকাই ভালো ছিল। এক রুমে এক সঙ্গে ৫০/৫১ জনকে রাখা হয়। তিন রুমের জন্য দুটি টয়লেট আর দু’টি ওয়াশরুম। রয়েছে পানির সংকটও।
পরিস্থিতি যখন এরকম তখন সত্যি সত্যিই যদি করোনা আক্রমণ করে তবে কি আমরা পারব এর মোকাবেলা করতে?
সেক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ের প্রতিকার বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা কি হতে পারে? প্রথমত, এর সংক্রমণ হতে পারে এমন সমস্ত রাস্তা আটকাতে হবে। চীনা নাগরিকদের অন অ্যারাইভাল ভিসা বন্ধ করে দেওয়ার মতো।
দ্বিতীয়ত, চীন থেকে পণ্য আসা আটকাতে হবে। সেক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতির হয়তো কিছুটা ক্ষতি হবে, কিন্তু একটা ভয়াবহ মহামারি আক্রমণের হাত থেকে বাঁচানো যাবে এদেশের মানুষদের।
তবে সে যাই হোক চীনের প্রকৌশলী এডিসন ঝাং ও তার স্বজনদের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে করোনা ভাইরাস কতটা ভয়াবহ হতে পারে।
তারা জানান, চিকিৎসকরা সাধারণ ঠাণ্ডা-জ্বরের পরীক্ষা করানোর পর তারা বাড়ি ফেরেন। পরের চারদিনে একে একে বাকি তিনজনই অসুস্থ হয়ে পড়েন। গত ৩০ জানুয়ারি ন্যাসোফ্যারিঞ্জিয়াল সোয়্যাব টেস্টে দেখা যায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন সবাই।
এবার বিপত্তি অন্য জায়গায়। যে স্থানীয় হাসপাতালে পরীক্ষা করাতে গেছিলেন তারা, সেখানে করোনা ভাইরাসের জন্য চিকিৎসা সুবিধা নেই। তারপর তাদের সবাইকে শহরের একটি উচ্চ স্তরের হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়।
তবে এবার নিশ্চিন্তই হলেন ঝাং, কেননা এখন অন্তত চিকিৎসা পাবেন তারা। চিকিৎসা না করে উপায় নেই সরকারের। কেননা করোনা ভাইরাসের পরীক্ষার টেস্টিং কিটের অভাবে অনেকেরই দেরিতে শনাক্ত হচ্ছে। এতে করে প্রাণহানির ঝুঁকি বেড়ে যায় অনেক।
তবে এডিসন সেইসব ভাগ্যবানদের একজন যারা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। তবে এখনও হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন তার স্ত্রী ও শ্বাশুড়ি। সুস্থ হওয়ার পর ৯ ফেব্রুয়ারি কোয়ারান্টাইনে পাঠানো হলো এডিসনকে। পুড়িয়ে ফেলা হলো সব বইপত্র, কাপড় জামা-সব।
এডিসন বয়সে তরুণ, নিয়মিত খেলাধুলা করেন, ব্যায়াম করেন। তাই অল্পের উপর দিয়ে সেরে উঠেছেন তিনি। কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন, বয়সে তুলনামূলকভাবে প্রবীণ, শহরে বাস করেন এমন মানুষদের করোনায় কাবু হয়ে পড়ার প্রবণতা বেশি।
সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এডিসন বলেন, আরও আগেই যদি ন্যাসোফ্যারিঞ্জিয়াল টেস্টটা করা যেতো, তাহলে হয়তো পরিবারের চারজনই আক্রান্ত হতাম না আমরা।
এডিসনের মতোই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন টাইগার ইয়ে। কিন্তু টাইগারের ঘটনাটা একটু ভিন্ন। চূড়ান্ত পরীক্ষায় করোনা ধরা পড়ার আগে মোট চারটি পরীক্ষা করিয়েছেন তিনি, সবকটাতেই ফলাফল-নেগেটিভ।
স্থানীয় ছোট্ট একটা হাসপাতালে সাধারণ ঠাণ্ডা-জ্বরের চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি। তাতে কোনো ফল না হওয়ায় কোনো রকমের প্রেসক্রিপশন বা ডায়াগনোসিস ছাড়াই শেষ পর্যন্ত শহরের বড় এক হাসপাতালে পাঠানো হয় তাকে। সেখানে পঞ্চমবারের মতো পরীক্ষা করা হলে শেষমেশ করোনা ধরা পড়ে টাইগারের।
২৬ জানুয়ারি মারাত্মক কাশি আর ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রার জ্বরে ভুগছিলেন টাইগার। সঙ্গে পেট ব্যথা, বমি আর ডায়রিয়া। হাসপাতালে টাইগারের এইচআইভি পরীক্ষা করা হয়, ঔষধ দেওয়া হয় এইচআইভির। প্রায় ১০ দিন হাসপাতালে চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে উঠতে থাকেন তিনি।
তারপর টাইগারকে জানানো হয় যে, ১৪ দিন কোয়ারান্টাইনে থাকতে হবে তাকে। ৯ ফেব্রুয়ারি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর একটা হোটেলে আলাদা রাখা হয় তাকে। ১৪ দিন পর সমস্ত কাপড়-চোপড়, বই খাতা আর জিনিসপত্র পুড়িয়ে ফেলার পর বাড়ি পাঠানো হয় তাকে।
কিন্তু যে দেশে করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি সেখানেই চিকিৎসার এমন দুরবস্থা কেন?
সোমবার বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, লোকজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার আগে অন্তত ছয়টি পরীক্ষার ফলাফলে আসে যে, তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নন।
এই পরীক্ষাগুলোতে ভাইরাসের জেনেটিক কোড খোঁজা হয়। রোগীর কাছ থেকে একটি নমুনা নেওয়া হয়। পরে পরীক্ষাগারে ভাইরাসের (যদি থাকে) জেনেটিক কোড বের করে তা বার বার কপি করা হয় যাতে তা শনাক্ত করা যায়।
রেডিওলোজি জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, ১৬৭ জন রোগীর মধ্যে ৫ জনের পরীক্ষায় আসে যে তাদের সংক্রমণ নেই। ফুসফুসের স্ক্যান পরীক্ষায় পাওয়া যায় যে তারা আক্রান্ত নয়।
কিন্তু পরে করা পরীক্ষার ফলাফলে জানা যায় যে, তারা আক্রান্ত। এ ধরনের আরও অসংখ্য ঘটনা রয়েছে।
এ সম্পর্কিত সম্ভাব্য ব্যাখ্যাটি হচ্ছে, পরীক্ষাগুলো যথার্থ কিন্তু পরীক্ষার সময় হয়তো রোগীদের মধ্যে করোনাভাইরাস থাকে না। চীনে এখন কাশি, ঠাণ্ডা আর জ্বরের মৌসুম। আর রোগীরা হয়তো এসব অসুখকেও করোনাভাইরাস বলে ভুল করছে।
কিংস কলেজ লন্ডনের ডা. নাথালি ম্যাকডারমট বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাথমিক উপসর্গগুলো শ্বাসযন্ত্রকে সংক্রমিত করে অন্য ভাইরাসগুলোর মতোই।
প্রথমবার পরীক্ষার সময় হয়তো তারা সংক্রমণের শিকার হয়নি। পরে হয়তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয় এবং পরে পরীক্ষা করলে তা ধরা পড়ে। এটা একটা সম্ভাব্য কারণ হতে পারে।
আরেকটি কারণ হতে পারে যে, রোগীর হয়তো করোনাভাইরাস আছে, কিন্তু এটা এতটাই প্রাথমিক পর্যায়ে এবং সংখ্যায় এতো কম থাকে যে শনাক্ত করার জন্য নমুনায় পর্যাপ্ত সংখ্যায় পাওয়া যায় না।
তবে ছয়বার পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে এই যুক্তি টেকে না বললেন ডা. ম্যাকডারমট। তিনি বলেন, ইবোলার ক্ষেত্রে, নেতিবাচক ফল আসার পরও আমরা ৭২ ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি ভাইরাসকে পর্যাপ্ত সময় দিতে।
অন্যদিকে পরীক্ষা কিভাবে করা হচ্ছে তাতেও সমস্যা থাকতে পারে। নমুনা যদি সঠিকভাবে সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা করা না হয় তাহলে পরীক্ষা কোনো কাজে আসবে না।