আরবদের সঙ্গে সখ্য গড়ার ইসরায়েলি পরিকল্পনায় বাধা দিয়েছে গাজা যুদ্ধ
গাজার সঙ্গে চতুর্থ যুদ্ধের লাভক্ষতি হিসাবে ইসরায়েল যখন ব্যস্ত, ঠিক সেই মুহূর্তেই পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে তেল আবিবের নতুন মিত্র আরব রাষ্ট্রগুলো এই বন্ধুত্বের মূল্য নিয়ে চিন্তিত। এই অঞ্চলের অন্য যেসব দেশ আব্রাহাম চুক্তিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল, নতুন করে তারাও হিসাব করতে বাধ্য হচ্ছে।
সাম্প্রতিক গাজা যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আবারও শিরোনাম হয়েছে অধিকৃত অঞ্চলসহ ইসরায়লের মধ্যে আরব ফিলিস্তিনি জনসংখ্যার সীমাহীন দুর্ভোগ ও বঞ্চণা। ফলে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের শাসকরা পড়েছেন বিব্রতকর অবস্থায়। একইসঙ্গে, ভবিষ্যতে চুক্তিতে আগ্রহী সৌদি আরব, কাতার এবং ওমানের শাসকরাও দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন।
জাতীয় কারণেই আমিরাত ও বাহরাইন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেয়। বিশেষ করে, প্রচণ্ড ইরানভীতি আছে বাহরাইনের শাসকদের। ১৯৬০ সালে ইরানের প্রাক্তন শাহ বাহরাইন দখলের চেষ্টা করেছিলেন, তখন থেকেই পারস্য উপসাগরের ওপাড়ের ইরানকে সভয়ে দেখে মানামার রাজপরিবার। তাছাড়া, সুন্নি শাসক পরিবার বিরোধী শিয়াদের ইসলামী প্রজাতন্ত্রটির দেওয়া অকুণ্ঠ সমর্থনও তাদের আতঙ্কের মাত্রা বাড়িয়েছে।
ইরানের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রই ছিল এতদিন আরব রাজতন্ত্রগুলোর প্রধান রক্ষক। কিন্তু, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনা উপস্থিতি কমানোর উদ্যোগের ফলেই বাহরাইন ইসরায়েলের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনে আগ্রহী হয়। কারণ, তেল আবিবও ইরানি অভিসন্ধিকেই নিজ অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করে।
ইরানি হুমকি নিয়ে সচেতন ছিল আমিরাতও। মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্কের উচ্চাভিলাষ নিয়েও দেশটি ইসরায়েলের মতোই সন্দিগ্ধ । আমিরাতি শাসকদের সবচেয়ে উদ্বেগের কারণ মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো সংগঠনকে দেওয়া আঙ্কারার পৃষ্ঠপোষকতা।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করা এবং ইসরায়লের প্রসিদ্ধ উচ্চ-প্রযুক্তি খাতের সুবিধা নিতে আমিরাত ও বাহরাইন আব্রাহাম অ্যাকর্ডে স্বাক্ষর করে।
ফিলিস্তিনিদের ওপর ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের আচরণে এবং জেরুজালেমের ওপর দাবির কারণে মিত্রতার এই চুক্তিটি যে মাঝেমধ্যেই প্রশ্নের মুখে পড়বে, সেটাও আমিরাত ও বাহরাইনের শাসকদের অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু, চুক্তি স্বাক্ষরের অল্প সময় পরই এত দ্রুত ও কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হবে, একথা হয়তো তারা ভাবতেও পারেননি।
সাম্প্রতিক সংঘাতের বীজ বোণা হচ্ছিল মে'র শুরুর দিকেই। ওই সময়ে জেরুজালেমে বিক্ষোভরত ফিলিস্তিনিদের ওপর দমনপীড়ন চরমাকার ধারণ করে। তারপর, আল আকসা প্রাঙ্গণে ইসরায়েলি পুলিশের আগ্রাসী অভিযান সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ক্ষোভের জন্ম দেয়। রাজনৈতিকভাবে নিস্ক্রিয় উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলোর নাগরিকেরাও এনিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকেন। ইসরায়েলের সঙ্গে একই পাতে অংশ নেওয়া আরব রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিরাসহ প্রায় সকল আরব প্রচণ্ড নিন্দা জ্ঞাপন করেন।
এমন ক্ষোভের অনুভূতি এবং নিজস্ব ভুলত্রূটির চাপ আমিরাতি ও বাহরাইনি সরকারকে বাধ্য করে জেরুজালেমে আর আল আকসা মসজিদে ইসরায়েলি কার্যকালাপের বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় বিবৃতি দিতে।
তবে হামাস পাল্টা রকেট হামলা চালাতে থাকলে আমিরাত ও বাহরাইনের ওপর চাপের মাত্রা কিছুটা কমে। তখন জেরুজালেম থেকে সরে সবার দৃষ্টি গাজায় আরেকটি যুদ্ধের দিকে নিবদ্ধ হয়।
দীর্ঘদিন ধরেই চরমপন্থী আদর্শ এবং সহিংসতাকামী মনোভাবের জন্য উপসাগরীয় দেশে হামাস খুবই অজনপ্রিয়। ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জেরুজালেমের ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্ব নিয়ে এসব দেশের জনগণ সহানুভুতিশীল হলেও, তাদের কাছে গাজা বা হামাসের তেমন কোনো গুরুত্বও নেই।
কিন্তু, এবার যখন গাজায় বেসামরিক ফিলিস্তিনি হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে তখন এর উল্টো চিত্রই দেখা যায়। পাল্লা দিয়ে বাড়ে ইসরায়েল বিরোধীতা। আমিরাত ও বাহরাইনের শাসকদের লজ্জা পেতে হয়, যখন তাদের চির প্রতিদ্বন্দ্বী কাতার নিজস্ব আল জাজিরা নিউজ নেটওয়ার্কে ইসরায়লি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ফিলিস্তিনিদের ক্ষয়ক্ষতি ও ভয়াবহ প্রাণহানির সংবাদ প্রচার করতে থাকে।
একটি দুর্বল যুদ্ধবিরতি এই সর্বনাশা প্রলয়ে বিরতি দিলেও, ইতোমধ্যেই আরব জনগণের দৃষ্টি ফিরে এসেছে জেরুজালেম ও আল আকসা ইস্যুতে। সেখানে আবারও বাড়ছে সহিংসতার উত্তেজনা। তাই একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সামনের দিনগুলোতে আমিরাত ও বাহরাইনের শাসকদের আরও বিব্রত হতে হবে।
আব্রাহাম অ্যাকর্ডে স্বাক্ষরকারী আরব দেশ দুটি স্পষ্ট বুঝতে পারছে, ইসরায়লের সঙ্গে এখন তাদের সম্পর্ক নির্ভর করবে এমন কিছু পক্ষের ওপর, যাদের ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এমন কিছু ঘটনার ওপর, যা তাদের থামানোর সাধ্য নেই। চুক্তির কথা যারা ভাবছিল সেসব উপসাগরীয় দেশও একই বার্তা পাচ্ছে। বস্তুত, ইসরায়েলের সাথে মিত্রতার বন্ধন গড়তে রাজতন্ত্রগুলোর নিজস্ব স্বার্থ যতোই থাকুক, সহসাই তারা সেদিকে পা বাড়াতে রাজি নন। অন্তত, চলতি মাসের দুর্ঘটনা জনগণের মন থেকে মুছে যাওয়ার আগপর্যন্ত তারা এমন সিদ্ধান্ত নেবেন না।
উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী সৌদি আরব, এই অঞ্চলের বেশিরভাগ রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে খাতির জমানোর অভিসন্ধি নিয়ে রিয়াদের ইঙ্গিতের প্রতিই নির্ভর করে। কিন্তু, রিয়াদের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রতিক্রিয়া উৎসাহব্যঞ্জক নয়। গত মঙ্গলবার ইসরায়েলের একটি যাত্রীবাহী বিমানকে সৌদির আকাশসীমায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। এর আগে আমিরাত আব্রাহাম চুক্তিতে স্বাক্ষর করার কিছু দিন পর রিয়াদ ফ্লাইট চলাচলের অনুমতি দিয়েছিল।
আব্রাহাম চুক্তিতে সৌদি আরবের স্বাক্ষর ইসরায়েল এবং প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জন্য হবে সবচেয়ে বড় পুরষ্কার। কারণ, পূর্বসূরী ট্রাম্পের মতো বাইডেনও আরব-ইসরায়েলি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের নীতি বজায় রেখেছেন। রিয়াদের অনুমোদন অন্য পক্ষগুলোর জন্যও চুক্তিতে যোগ দেওয়া সহজ করবে। তাছাড়া, আঞ্চলিক প্রভাব ছাড়াও মুসলিম বিশ্বের বড় অংশে এখনও নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে সৌদি আরব। কিন্তু, সেকারণেই সৌদি শাসকেরা আরও বেশি সতর্ক, কারণ তারা জানেন হিসাবে ভুল করলে তার জন্য অনেক চড়া মূল্যও দিতে হতে পারে।
- লেখক: হুসেইন ইবিশ ওয়াশিংটন ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক আরব গালফ স্টেটস ইনস্টিটিউটে যুক্ত জ্যেষ্ঠ গবেষক
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত