আফগানিস্তান যেভাবে ফের তালেবানের দখলে চলে গেল
দক্ষিণের হেলমান্দ উত্তরে কান্দাহার পর্যন্ত আফগানিস্তানে সর্বত্র এখন তালেবানের পদচারণা।
গত মে থেকে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তান ছাড়ার প্রক্রিয়া শুরুর পরপরই দেশটির বিশাল গ্রামাঞ্চলের দখল নিয়েছে তালেবান। দলটি এখন হেরাট ও কাবুলের মতো বড় শহরগুলোর প্রবেশদ্বারে কড়া নাড়ছে।
তালেবান যদি এই দখলের লড়াইয়ে চূড়ান্তভাবে জয়ী হয়, তবে আফগানিস্তানে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর দুই দশকের অর্জন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।
আফগান সরকার একেবারে আচমকাই জিহাদি গ্রুপটির চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেছে। সরকারি বাহিনী এখন সৈন্যসংখ্যা, অস্ত্রশস্ত্র সবদিক থেকেই তালেবানের কাছে মার খাচ্ছে।
আফগানিস্তানের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চল তালেবানের শক্ত ঘাঁটি। তাই ওদিক থেকে আক্রমণ আসা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে জোরালো হামলা এসেছে উত্তরাঞ্চল থেকেও। অথচ ঐতিহাসিকভাবেই ওই অঞ্চলে তালেবান দুর্বল।
গত মে-তে দলটি আফগানিস্তানের ৪০০টি জেলার মধ্যে ৫০টিই দখল করে নেয়। কিছু তথ্যানুযায়ী, অর্ধেক আফগানিস্তান এখন তালেবানের দখলে। সম্প্রতি একটি মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সতর্ক করে দেয়া হয়, আগামী ছয় মাসের মধ্যে গ্রুপটি ফের রাজধানী কাবুল দখল করে নিতে পারে।
সম্প্রতি ইমাম সাহেব জেলায় এক যুদ্ধে ১০০ জন সরকারি সৈন্য ৩০০ তালেবান যোদ্ধার মুখোমুখি হয়েছিল। দুই দিনব্যাপী সেই যুদ্ধে জয়ের হাসি জিহাদিদের মুখেই ফোটে।
আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে এরকম আরও অনেকগুলো যুদ্ধে জিতেছে তালেবান। ফলে তাজিকিস্তানের সীমান্তসংলগ্ন অঞ্চল চলে গেছে তাদের দখলে। অঞ্চলটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য রুট।
বেশিরভাগ যুদ্ধেই সরকারি বাহিনী মোটামুটি বিনা বাধায় আত্মসমর্পণ করেছে কিংবা পালিয়ে গেছে।
আফগানিস্তানের তৃতীয় বৃহত্তম শহর হেরাট থেকে মাত্র ১৬ মাইল দূর পর্যন্ত চলে এসেছে তালেবান যোদ্ধারা। রাস্তার দুপাশেই বিজয় নিশান উড়িয়ে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে তালেবানরা।
হেরাটের মাত্র একটি সেনাঘাঁটিতে এখনও দখল ধরে রেখেছে সরকারি বাহিনী। পর্যাপ্ত সৈন্যবল ও অস্ত্রের অভাবে সর্বত্র মার খাচ্ছে সরকারি সৈন্য—চলে যাচ্ছে ঘাঁটি ছেড়ে।
মোহাম্মদ নাসিম নামে এক সরকারি সৈন্য এক মাস তালেবান যোদ্ধাদের সঙ্গে একা যুদ্ধ করেছেন। খাদ্যের অভাবে শেষে তাকে বেরি ও ঘাস খেয়ে থাকতে হয়েছে। তার সঙ্গের সব সৈন্য প্রাণ হারিয়েছেন এ লড়াইয়ে। অবশেষে সাহায্য আসায় তিনি প্রাণে বেঁচে গেছেন।
আমেরিকাভিত্তিক 'লং ওয়ার জার্নাল'-এর সম্পাদক বিল রোগিয়ো জানিয়েছেন, হাজার হাজার আফগান সেনা ও পুলিশ তাদের আউটপোস্ট ছেড়ে পালিয়েছে।
গত বুধবার কাবুলের উত্তরাঞ্চলের কোহ দামান গ্রামে সশস্ত্র গ্রামবাসীরা তালেবানবিরোধী মিছিল বের করে। এই মিলিশিয়ারাই এখন আফগান পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সহায়।
মোমান নামে এক পুলিশ সদস্য আফগান প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা করে বলেন, সরকার বেশি বেতন দিয়ে ওইসব মন্ত্রণালয়ে কর্মচারী রেখেছে, অথচ যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিকরা বেতন পান খুবই কম। মোমানের সঙ্গে দায়িত্ব পালনরত অন্য পুলিশও এ সমালোচনায় সায় দেন। আফগান নিরাপত্তা বাহিনীতে যোগ দেয়া নতুন সৈন্যরা মাসে ১৫২ ডলার করে বেতন পান, ঊর্ধ্বতন কর্তাদের মাসিক বেতন ৩৮০ ডলার।
আমেরিকা ও ন্যাটো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আফগানিস্তান ন্যাশনাল সিকিউরিটি এবং ডিফেন্স ফোর্সেস-কে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ৪০০ কোটি ডলার অর্থসহায়তা দেবে।
কিন্তু আফগান সরকারে সর্বব্যাপী দুর্নীতির কারণে আফগান বাহিনী ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছে।
এসবের মধ্যেই আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানি তার স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে পরিবর্তন এনেছেন। বিসমিল্লাহ খানকে ফের নিয়োগ দিয়েছেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে।
বিসমিল্লাহ খান এর আগে দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত হয়েছিলেন। তার মিলিশিয়া বাহিনী ১৯৯৬-এ সরকারি ও তালেবান বাহিনীর গৃহযুদ্ধে নৃশংসতার জন্য প্রচণ্ড সমালোচিত হয়েছিল।
আফগান ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকের আশঙ্কা আবারও ওরকম গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। ১৯৯০-এর দশকের যুদ্ধে একাধিক গোত্রপতি ক্ষমতা দখলের জন্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ফলে কাবুল পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে, প্রাণহানি হয়েছিল অন্তত ৫০ হাজার মানুষের।
তালেবানের পতনের পর ওই গোত্রপ্রধানরা ক্ষমতায় ফেরেন। এরপর থেকে তারা সম্পদ ও ক্ষমতায় কেবল বড়ই হয়েছেন।
এই নেতারা একে অপরকে এক বিন্দু বিশ্বাস করেন না। পরস্পরের প্রতি তারা প্রচণ্ড ঈর্ষাকাতর। এবং গানির প্রতি তাদের আনুগত্য সরল দোলকের মতোই দোদুল্যমান।
আফগান মিলিশিয়া ও নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনীর বেতনও প্রায়ই কয়েক মাস আটকে থাকে। দুর্নীতির কারণে মিলিশিয়াদের জন্য বরাদ্দকৃত তহবিল থেকে টাকা উধাও হয়ে যায় প্রায়ই। ফলে অসন্তোষ বাড়ছে দিন দিন। এসবের চূড়ান্ত ফলশ্রুতিতে স্থানীয় নেতা ও গোত্রপ্রধানরা শিগগিরই গানির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবেন বলে আশঙ্কা অনেকের।
সরকারের এসব দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা ও অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে লাভবান হয়েছে তালেবান। তারা এখন আশা করছে, ক্ষমতা দখল করতে পারলে, আঞ্চলিক ক্ষমতাগুলোর সঙ্গে কূটনীতিক আলোচনাতেও বসতে পারবে।
এ সপ্তাহের শুরুর দিকে এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তালেবান ইতিমধ্যে একবার ভারতের সঙ্গে আলোচনাও সেরে ফেলেছে। অথচ পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার কারণে দীর্ঘকাল ধরেই ইসলামপন্থী দলটি ভারতের অপছন্দের তালিকায় আছে। এক তালেবান কর্মকর্তা জানান, 'বৈঠকটি ভারতের অনুরোধে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।' ভারত অনুরোধ করেছে, তালেবান যেন ভারতবিরোধী সশস্ত্র কোনো দলকে সমর্থন না দেয়।
এসবের ডামাডোলেই গতকাল ২৫ জুন ওয়াশিংটনে গানির সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের। সেখানে বিপর্যয় কীভাবে এড়ানো যায়, তা নিয়ে আলাপ করার কথা রয়েছে।
আশার কথা হচ্ছে, আরেকটি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ এড়ানোর জন্য আফগান সরকার ও তালেবান একধরনের ক্ষমতা ভাগাভাগিতে রাজি হতে পারে।
কিন্তু এমন কোনো চুক্তিতে তালেবানদের রাজি হওয়ার যুক্তিসংগত কোনো কারণ নেই বললেই চলে। কারণ তাদের ধারণা ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে তারাই জিতছে। সুনিশ্চিত জয়ের সুঘ্রাণ পাওয়ার পর ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তি করার কোনো যুক্তি হয় না।
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী সরিয়ে আনার সিদ্ধান্তটা অত্যন্ত অদূরদর্শী ও বোকামি হয়েছে। তাদের মতে, এ পদক্ষেপ আমেরিকার সুনাম ক্ষুণ্ণ তো ক্ষুণ্ণ করবেই, সেইসঙ্গে আফগান অঞ্চলের স্থিতিশীলতাও নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী বিদায় নেওয়ার পর পাকিস্তান, ইরান, মধ্য এশিয়া, চীন, এমনকি সম্ভবত রাশিয়াও এ অঞ্চলে ছায়াযুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। অনেকে এখনও আশা করছেন, বাইডেন হয়তো দেশটিতে কিছু মার্কিন সৈন্য রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সুবিবেচনার পরিচয় দেবেন। যদিও ওয়াশিংটন থেকে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।
আফগান সরকার ও তার মিত্রদের ধারণা, আফগানিস্তানে এবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হবে।
হেরাটে দায়িত্বরত ২৫ বছর বয়সি যোদ্ধা সাইফুল্লা ডেইলি মেইলকে বলেন, 'আমেরিকা আর ব্রিটেন আমাদের দেশে এসে তালেবানদের সঙ্গে যুদ্ধের আগুন জ্বালিয়েছে। এখন সেই আগুন না নিভিয়েই পালাচ্ছে বিদেশিরা। আমাদেরকে ফেলে যাচ্ছে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে একা যুদ্ধ করার জন্য।'
সূত্র: ডেইলি মেইল
আরও পড়ুন: তালেবান টিকে থাকলে কার লাভ কার ক্ষতি?