অভূতপূর্ব বিদ্যুৎ সংকটের মুখে চীন, ভারত
স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট চোখরাঙানি দিচ্ছে এশিয়ার দুই বৃহত্তম অর্থনীতি চীন ও ভারতকে।
দুই দেশেই সিংহভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহ আসে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে।
চীনের বড় কয়লা খনিগুলো ভারী বৃষ্টিপাত এবং প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার মতো সমস্যায় জর্জরিত। বিদ্যুতের আকাশচুম্বী মূল্যের সঙ্গে এসব সমস্যা চীনের বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবেলার প্রচেষ্টাকে আরও জটিল করে তুলছে।
অন্যদিকে, কয়লার মজুদ মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে কমে যাওয়ায় ভারতের ১৩৫টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্ধেকেরও বেশি এখন ধুঁকে ধুঁকে চলছে।
মহামারির ধকল কাটিয়ে অর্থনীতি পুনরায় চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়ে বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়ছে। কিন্তু চাহিদার সঙ্গে ঠিক তাল মেলাতে পারছে না সরবরাহ।
ভারী বৃষ্টিপাত এবং প্রাণঘাতী দুর্ঘটনায় বিপর্যস্ত চীন
চীনের বিদ্যুৎ ঘাটতির পিছনে বেশ কিছু কারণ জড়িত। মহামারী-পরবর্তী অবকাঠামো নির্মাণ বৃদ্ধি, কার্বন নিঃসরণ কমাতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কমানোর জাতীয় প্রয়াস এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
দেশটির প্রধান বিদ্যুৎ সরবরাহকারী অস্ট্রেলিয়ার কয়লার উপর নিষেধাজ্ঞা এবং আবহাওয়াজনিত সমস্যা এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
বিশেষ করে আবহাওয়া জনিত সমস্যা সাম্প্রতিক সময়ে তীব্র রূপ ধারণ করেছে। এ সপ্তাহেই ভারী বৃষ্টির ধকলে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছে শানসি প্রদেশ। দেশের প্রায় অর্ধেক কয়লা উৎপাদিত হয় এই প্রদেশ থেকেই।
শানসির জিয়ানিয়াং শহরের একটি কয়লা খনিতে ছাদ ভেঙে পড়ায় আরও গুরুতর রূপ ধারণ করেছে এ সংকট। এই ঘটনায় চারজন খনি শ্রমিক নিহত এবং চারজন গুরুতরভাবে আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম জিনহুয়া।
এদিকে প্রাথমিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত তাপীয় কয়লার দাম বেড়েই চলেছে। গত সোমবার আট শতাংশ এবং মঙ্গলবার ১১ শতাংশ বাড়ার পর কয়লার দাম প্রতি মেট্রিক টনে প্রায় ১,৫০৮ ইউয়ানে (২৩৪ মার্কিন ডলার) এসে দাঁড়িয়েছে, যা একটি নতুন রেকর্ড।
বিরূপ আবহাওয়ার জন্য এ মাসের শুরুতে শানসির ৬০টি কয়লা খনিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে চারটি বাদে বাকি খনিগুলোকে খুলে দেওয়া হলেও চীনের এই কয়লা ও বিদ্যুৎ সংকট শীতকালেও অব্যাহত থাকবে বলে সতর্ক করে দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
চীনের শীর্ষ অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকারী প্রতিষ্ঠান, ন্যাশনাল রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কমিশন এসব সমস্যা নিয়ে তৈরি হওয়া উদ্বেগকে শান্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। গত মঙ্গলবার তারা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের বিদ্যুতের জন্য বেশি দাম নেওয়ার অনুমতি দিতে চলেছে।
শুক্রবার থেকে চীনের সকল শিল্প ও বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোকে বাজার দামে বিদ্যুৎ কিনতে হবে জানিয়েছে জিনহুয়া। বেইজিং ইতোমধ্যেই স্পষ্ট করে দিয়েছে যে বিদ্যুতের দাম সরকার নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো যাবে।
সাধারণ জনগণ এবং কৃষি শিল্প এই মূল্য বৃদ্ধির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বলে জানিয়েছে চীন সরকার।
সম্ভাব্য 'বিদ্যুৎ সংকট' সম্পর্কে সতর্ক করছেন ভারতীয় নেতারা
এদিকে ভারতে রাজ্য সরকারের নেতা-নেত্রীরা কেন্দ্রীয় সরকারকে কয়লার ঘাটতি সম্বন্ধে সতর্ক করছেন।
সম্প্রতি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, অচিরেই বিদ্যুৎ সংকটের মুখোমুখি হতে পারে রাজধানী। সম্ভাব্য জ্বালানি সংকট সম্পর্কে সতর্ক করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে একটি চিঠিও লিখেছেন বলে জানান তিনি।
অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী জগন মোহন রেড্ডিও সম্প্রতি মোদিকে বলেছেন তার অঞ্চলে জ্বালানি পরিস্থিতি "উদ্বেগজনক"।
ভারতের বেশিরভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লার মজুদ আশঙ্কাজনক হারে কমে এসেছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ (সিইএ) গত রোববার এক প্রতিবেদনে বলেছে, দেশের ১৩৫টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে ৬১টিতেই কয়লার সরবরাহ সপ্তাহে দুই দিনও থাকছে না। এদের মধ্যে ১৬টিতে কয়লার মজুদ নেই বললেই চলে।
তবে জনগণের চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে বলে দাবি করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার।
রবিবার এক বিবৃতিতে কয়লা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কয়লাচালিত কারখানায় মোট জ্বালানির মজুদ রয়েছে প্রায় ৭২ লাখ মেট্রিক টন, যা সপ্তাহে চার দিনের জন্য যথেষ্ট। মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, সরকারি মালিকানাধীন খনিজ কোম্পানি কোল ইন্ডিয়ার কাছে ৪ কোটি মেট্রিক টনেরও বেশি কয়লার মজুদ রয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, "বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যাঘাত আসার যে কোনো আশঙ্কাই সম্পূর্ণরূপে ভুল।"
এরপরও বিশ্লেষকরা ভারতের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি "অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে" উল্লেখ করেছেন। যদিও কোল ইন্ডিয়া দাবি করছে তাদের দৈনিক সরবরাহ বেড়েছে, কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন কিছু প্রদেশ তাদের চুক্তিবদ্ধ পরিমাণের অর্ধেক বিদ্যুৎ সরবরাহও পাচ্ছে না। পাঞ্জাব এবং ঝাড়খণ্ড রাজ্যে বিদ্যুতের ঘাটতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে।
সূত্র: সিএনএন।