সানোয়ারা গ্রুপ: যেভাবে গড়ে উঠল একটি বৃহৎ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান

চট্টগ্রামের একজন সফল শিল্পোদ্যোক্তা, শিক্ষানুরাগী ও রাজনীতিক নুরুল ইসলাম বিএসসি। ১৯৭৮ সালে কাস্টমসের চাকরি ছেড়ে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা শুরু করেন পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে। অল্প সময়েই ভোগ্যপণ্য আমদানি ও ব্যবসায় বেশ সুনাম অর্জন করে তার প্রতিষ্ঠান 'সানোয়ারা করপোরেশন'। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশের শীর্ষস্থানীয় ভোগ্যপণ্য আমদানিকারকদের তালিকায় অন্যতম ছিল সানোয়ারা করপোরেশন।
ভোগ্যপণ্য ব্যবসার পাশাপাশি ১৯৭৮ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়ান গুঁড়াদুধের ব্র্যান্ড রেডকাউ-এর একমাত্র বাংলাদেশি এজেন্ট ছিল সানোয়ারা করপোরেশন। ২০০৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২৫ বছর রেডকাউ নিয়ে সফল ব্যবসা করে সানোয়ারা।
১৯৮৭ সালে ৩০০ একর জমি নিয়ে চন্দনাইশের দোহাজারী এলাকায় গড়ে তোলেন সানোয়ারা পোল্ট্রি এন্ড হ্যাচারি। দীর্ঘ ২৫ বছর এই শিল্পে সফলতার সাথে ব্যবসা করেন তিনি। চট্টগ্রামের পোল্ট্রি এন্ড হ্যাচারি শিল্পের পথিকৃৎ বলা হয় নুরুল ইসলাম বিএসসিকে।
১৯৯১ সালে চান্দগাঁও শিল্প এলাকায় গড়ে তোলা হয় ইউনিল্যাক সানোয়ারা (বিডি) লিমিটেড। যেখানে গুঁড়াদুধ আমদানি ও রিপ্যাকিং করা হয়। একসময় এই কারখানায় ডিপ্লোমা ফ্যালকন ব্র্যান্ডের গুঁড়াদুধ রিপ্যাকিং করে বাজারজাত করা হতো। বর্তমানে কোয়ালিটি, ডিপ্লোমিল্ক ও বাজেট নামে গুঁড়াদুধ রিপ্যাকিং করে বাজারজাত করা হচ্ছে। কারখানাটিতে বর্তমানে ১৫০ এর বেশি কর্মী কাজ করছে।
১৯৯৫ সালে গড়ে ওঠে সানোয়ারা ডেইরি এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। কারখানাটিতে কোয়ালিটি ব্র্যান্ডের বাটার অয়েল ও কোয়ালিটি ঘি উৎপাদন করা হয়। এখানে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫০ জনের।
দেশের আইসক্রিমের বাজারে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সানোয়ারা গ্রুপের কোয়ালিটি আইসক্রিম। গ্রুপটির কোয়ালিটি আইসক্রিমের মধ্যে ৮০ রকমের মজাদার ভ্যারাইটি রয়েছে। এরমধ্যে ৪০ রকমের প্রিমিয়াম (পার্লার) কোয়ালিটি রয়েছে। যা কোয়ালিটি এবং সাবজিরো ব্রান্ডের নামে বাজারজাত হয়। এই আইসক্রিম এবং ইয়েস ব্র্যান্ডের মিনারেল ওয়াটার উৎপাদন হয় সানোয়ারা ড্রিংকস এন্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া কারখানাটি ঘিরে বর্তমানে ৫০০ এর বেশি লোক কাজ করছে।
গ্রুপটির সানোয়ারা ডেইরি ফুডস লিমিটেডে উৎপাদন হয় কোয়ালিটি কনডেন্সড মিল্ক এবং কোয়ালিটি গুঁড়াদুধ। ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া কারখানাটিতে বর্তমানে ৩০ জন কাজ করছে।
১৯৯৮ সালে কালুরঘাট শিল্প এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় সানোয়ারা প্লাস্টিক প্রোডাক্টস লিমিটেড। কারখানাটিতে কন্টেইনার ও বোতলসহ বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন হয়। এখানে কাজ করছেন বর্তমানে ৫০ জন কর্মী।
চট্টগ্রামের আবাসন খাতে ১৯৯৮ সাল থেকে ব্যবসা করে আসছে গ্রুপটির সানোয়ারা হোল্ডিং লিমিটেড। নগরীর মৌলভী পুকুরপাড় এলাকায় 'সানোয়ারা আবাসিক প্রকল্প' বাস্তবায়ন করে প্রতিষ্ঠানটি। যা চট্টগ্রামের বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠা প্রথম আবাসিক প্রকল্প। পরবর্তীতে বলির হাট এলাকায় 'সানোয়ারা আবাসিক দ্বিতীয় প্রকল্প' বাস্তবায়িত হয়। বর্তমানে উত্তর চান্দগাঁওতে 'সানোয়ারা সিটি' নামে তৃতীয় প্রকল্প চলমান রয়েছে।
২০১০ সাল থেকে কোয়ালিটি টি ও কোয়ালিটি চিপস বাজারজাত করে আসছে সানোয়ারা কন্জুমার প্রোডাক্টস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির কোয়ালিটি টি এর ভালো বাজার রয়েছে চট্টগ্রামসহ পাশের জেলাগুলোতে।
নগরীর পশ্চিম খুলশিতে ১৯৯৭ সালে গড়ে ওঠে সানোয়ারা প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। কার্টুন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে ১২০ জন লোক কাজ করছে।
টয়লেট ক্লিনার, ফ্লোর ক্লিনার, গ্লাস ক্লিনার, ফার্নিচার শাইনার, ডিশ ক্লিনারসহ বিভিন্ন টয়লেট্রিজ পণ্য উৎপাদন করে সানোয়ারা ইন্টারন্যাশনাল প্রোডাক্টস লিমিটেড। নগরীর কালুরঘাট বিসিক শিল্প এলাকায় কারখানাটি গড়ে তোলা হয় ১৯৯৪ সালে। কারখানাটিতে বর্তমানে ৫০ জন লোক কাজ করছে।
২০১১ সালে গড়ে তোলা হয় কোয়ালিটি ফার্নিচার কারখানা। নগরীর কালুরঘাট এলাকার এই কারখানার ফার্নিচার যাচ্ছে চট্টগ্রামের পাশের জেলাসহ সারা দেশে। এই কারখানাতে ৫০ জনের অধিক কর্মী নিয়োজিত।
সর্বশেষ ২০১৯ সালে গড়ে উঠে গ্রুপটির সানোয়ারা এগ্রো লিমিটেড।যেখানে চিকেন সমুচা, রোল, ভেজিটেবল সমুচা, ভেজিটেবল সিংগারা, ডালপুরি, অনথন, রুটি, পরোটা, নাগেটস এবং ফ্রেঞ্চ ফ্রাই সহ বিভিন্ন রকমের ফ্রোজেন ফুড উৎপাদন ও বাজারজাত হয়। এই কারখানা ঘিরে ১০০ এর বেশি লোক কাজ করছে।
এছাড়া ফিফথ এভিনিউসহ নগরীর অভিজাত এলাকায় চারটি কনভেনশন হল রয়েছে সানোয়ারা গ্রুপের।
১৯৯০ সালের পর থেকে ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করে সানোয়ারা গ্রুপ। বর্তমানে গ্রুপটির ১২টি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। গ্রুপটির বর্তমান বার্ষিক টার্নওভার ৩০০ কোটি টাকা এবং বর্তমান মোট মূলধন দুই হাজার কোটি টাকা। সানোয়ারা গ্রুপের এসব প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে প্রায় দেড় হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত রয়েছে। খুব শিগগিরই কসমেটিকস এবং স্ন্যাকস উৎপাদনে যাচ্ছে তারা।
সরকারি চাকরি ছেড়ে সফল শিল্পদ্যোক্তা নুরুল ইসলাম বিএসসি
চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও এলাকায় ১৯৪৩ সালে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নুরুল ইসলাম বিএসসি। স্থানীয় এনএমসি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯৫৯ সালে। এরপর ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন চট্টগ্রাম কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে।
বিজ্ঞান বিভাগে বই-খাতার খরচ জোগাড় করতে বিক্রি করতে হয়েছিল মায়ের কানের দুল। সেই থেকে নুরুল ইসলাম বিএসসি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হলে মানুষের দোড়গোড়ায় শিক্ষাকে পৌঁছে দেয়ার কাজ করবেন।
১৯৬৪ সালে যখন তিনি সানোয়ারা বেগমের সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন তখন তিনি বিএসসি পরীক্ষার্থী। পরীক্ষা শেষে ২০০ টাকা বেতনে যোগ দেন রহমানিয়া স্কুলের বিজ্ঞান ও অংকের শিক্ষক হিসেবে।তখন বিএসসি শিক্ষকের অভাব থাকায় স্কুলের শিক্ষার্থীরা তাকে 'নুরুল ইসলাম বিএসসি স্যার' নামে সম্বোধন করতেন। সেই থেকেই বিএসসি যেন তার টাইটেলে পরিণত হয়। পরে স্কুলের শিক্ষকতা ছেড়ে ৩৭৫ টাকা বেতনে যোগ দেন কাস্টমসে। কাস্টমসে চাকরিরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে 'কর্ণফুলী নদী চ্যানেলের' মানচিত্র চুরি করে মুক্তিবাহিনীকে সরবরাহ করেন তিনি। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ১৫-২০ জন যুবক মিলে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র ঘিরে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেন তাদের মধ্যে নুরুল ইসলাম বিএসসি একজন।
১৯৭৮ সাল থেকে সফলভাবে এক দশক ব্যবসা পরিচালনার পর ১৯৮৯ সাল থেকে আত্মনিয়োগ করেন সমাজকর্মে। চট্টলার শিক্ষানুরাগী হিসেবে পরিচিত নুরুল ইসলাম বিএসসি এ পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগর থেকে আশপাশের উপজেলা ও দুর্গম এলাকা পর্যন্ত ৩২টি নানামুখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে বছরে এখনো ১ কোটি টাকা ব্যয় করে সানোয়ারা গ্রুপ।
নুরুল ইসলাম বিএসসি ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালী আসন থেকে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই নুরুল ইসলাম বিএসসি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী হন। ২০১২ সাল থেকে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি।
বার্ধক্যজনিত কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে অবসর নিয়েছেন নুরুল ইসলাম বিএসসি। বর্তমানে গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন তার বড় ছেলে মুজিবুর রহমান।
মুজিবুর রহমান বলেন, "বাবা (নুরুল ইসলাম বিএসসি) তিলে তিলে এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ব্যবসার পাশপাশি শিক্ষার প্রসার এবং সমাজ কল্যাণে বিলিয়ে দেন নিজেকে। আমরা চাই, বাবার গড়া এসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো সম্প্রসারণ করতে। নতুন নতুন আরো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে, আরো মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করতে।"