মাত্রাতিরিক্ত জরিমানা ও কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বাড়ায় ব্যবসায়ীদের হয়রানির আশঙ্কা
প্রস্তাবিত ফাইন্যান্স বিলের আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও কাস্টমস এর বেশকিছু ক্ষেত্রে বড় ধরণের জরিমানার পাশাপাশি কর্মকর্তাদের বিস্তর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এর ফলে ক্ষমতার অপব্যবহার ও হয়রানি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
যদিও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা বলছেন, ফাঁকি ঠেকানো এবং কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এসব বিধান আনা জরুরি ছিল।
অবশ্য বেশকিছু প্রস্তাবে ব্যবসাকে সহজ করতে জরিমানা কমানোর প্রস্তাবও রয়েছে।
আয়কর আইনে ১৬টি সোর্স ট্যাক্স ডিডাকটিং অথরিটি রয়েছে, নতুন করে আরো চারটি খাত যোগ হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি উভয় প্রতিষ্ঠানই রয়েছে।
সোর্স ট্যাক্স কর্তন করতে না পারলে বা কম কাটলে ওই পরিমাণ অর্থের পাশাপাশি প্রতি মাসে ২% হারে জরিমানা রয়েছে। ওই অর্থ পরিশোধ না করতে পারলে নতুন করে ডিডাকটিং অথরিটিকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হবে। আবার ফাইন্যান্স বিলে, আলোচ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর নথিপত্র ও কম্পিউটারে রক্ষিত হিসাবপত্রসহ দেখার জন্য ট্যাক্স অফিসারদের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে কোন ধরণের বাধা দেওয়া হলে বা অসহযোগিতা করা হলে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হবে।
আনডিসপুটেড ট্যাক্স আদায়ের জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ক্ষমতা পাচ্ছেন ট্যাক্স অফিসাররা। এজন্য তারা আলোচ্য পরিষেবা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের সহায়তা নেবেন।
একইভাবে বকেয়া ভ্যাট পরিশোধ না হলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরিষেবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ক্ষমতাও পাচ্ছেন ভ্যাট অফিসাররা। এছাড়া ভ্যাট নির্ধারণে কিছু ক্ষমতা এতদিন কমিশনারের হাতে থাকলেও তা এখন সহকারি কমিশনার পর্যায়ে দেওয়ার প্রস্তাব এসেছে।
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, এভাবে ঢালাও জরিমানা এবং অফিসারদের হাতে ক্ষমতা দেওয়ায় প্রস্তাব পাশ হলে এর অপপ্রয়োগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে ব্যবসায়ীরা হয়রানির আশঙ্কাও করছেন।
সরকারের সোর্স ট্যাক্স খাত থেকেই বড় অংকের রেভিনিউ আসে। এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, মোট ট্যাক্সের প্রায় ৬০% আদায় হয় এ খাত থেকে।
ফাইন্যান্স বিলে এ ধরনের কিছু প্রস্তাবকে 'নিবর্তনমূলক' আখ্যা দিয়ে তা সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু। টিবিএসকে তিনি বলেন, 'অন্যথায় আমরা আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়ার কথাও ভাববো।'
তিনি বলেন, কোন অনিয়ম থাকলে নোটিশ দেওয়া হবে, অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান জবাব দেবে বা আইনি প্রক্রিয়ায় জরিমানা হবে এবং আপিলের সুযোগ থাকবে। কিন্তু একজন ডেপুটি কমিশনার গিয়ে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করে দেবে, এটা সভ্য সমাজে হতে পারে না। তাদের হাতে এত বড় ক্ষমতা দেওয়ার কারণে ব্যবসায়ীদের হয়রানি ও দুর্নীতি বাড়বে।
তিনি বলেন, এক্ষেত্রে দেখা গেল, যে কোন ছুতোয় হয়তো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উপর বড় অঙ্কের জরিমানা করার কথা বলবে, এবং তখন একটি অ্যামাউন্টে দফারফা হয়ে যাবে। তাতে সরকার কোন টাকা পেলোনা, দুর্নীতি বাড়ল আর প্রতিষ্ঠানের হয়রানি হলো।
তবে অসহযোগিতার জন্য ৫০ লাখ টাকা জরিমানার প্রস্তাব প্রসঙ্গে এনবিআরের মাঠ পর্যায়ের একজন ডেপুটি কমিশনার অব ট্যাক্সেস নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'অনেক সময়ই সোর্স ট্যাক্স কর্তনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে গেলে সহযোগিতা করা হয় না। নানা ছুতোয় বিশেষত, সংশ্লিষ্ট অফিসার নেই, ওই সময়ে ইলেকট্রিসিটি চলে যায়, নথিপত্র না দেওয়া, সংশ্লিষ্ট অফিসার ছুটিতে, অফিস বন্ধ থাকার মত অসহযোগিতা করা হয়। আইনি ক্ষমতা না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। নতুন এ প্রস্তাব অনুমোদন হলে ট্যাক্স আদায়ে কমপ্লায়েন্স তৈরির পরিবেশ নিশ্চিত হবে।'
সাবেক এনবিআর সদস্য মোঃ আলমগীর হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের সোর্স ট্যাক্স কর্তনকারী অনেক প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা তিক্ত। অনেকেই ট্যাক্স ডিডাক্ট করে না, কম ডিডাক্ট করে, টাইমলি জমা দেয় না, হাফ ইয়ারলি উইথহোল্ডিং রিটার্ন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও দেয় না, অডিটে সহায়তা করে না এবং সময়মত দরকারি নথিপত্র জমা দেয় না। এ তালিকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সোর্স ট্যাক্স কর্তনকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
এই প্রস্তাব রেভিনিউ আদায়ের চেয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ট্যাক্স কমপ্লায়েন্সের মধ্যে আনার চেষ্টার অংশ হিসেবেই করা হয়েছে বলে মনে হয়।'
তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের সতর্ক হতে হবে, যাতে অপব্যবহার না হয়।
অবশ্য জরিমানার ক্ষেত্রে ট্যাক্স কর্মকর্তাদের হাতে এত বিপুল ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে নন অর্থনীতিবিদরাও।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের হাতে এমনিতেই বিপুল ক্ষমতা দেওয়া আছে, যা থাকা উচিত নয়। এক ব্যক্তির হাতেই আইন প্রণয়ন, প্রয়োগ ও বিচারিক ক্ষমতা। তারা রেজিস্ট্রেশন দেন, ট্যাক্স রিটার্ন নেন, ইনস্পেকশন-অডিট করেন। এটি থাকা উচিত নয়। পৃথিবীর কোথাও এমন ব্যবস্থা নেই। নতুন করে আরো ক্ষমতা বাড়ানো হলে অনিয়ম ও হয়রানির বিশাল সুযোগ তৈরি হবে, এমন পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসা উচিত।'
তিনি বলেন, '২০১২ সালের প্রস্তাবিত ভ্যাট আইনে কর্মকর্তাদের ক্ষমতা কমানোর কথা বলা ছিলো। কিন্তু ওই কাটাছেঁড়া করে তাদের ক্ষমতা যথারীতি বাড়ানো হয়।'