সব ব্যাংককে এক হারে ডলার বিক্রি করতে হবে
বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় বাজারের অস্থিতিশীলতা কমাতে এখন থেকে সব ব্যাংককে এক হারে ডলার বিক্রি করতে হবে।
বৃহস্পতিবার (২৬ মে) বিকেলে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অভ ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি)-এর সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক-এর এক ত্রিপক্ষীয় সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সভার সূত্র থেকে জানা গেছে, এবিবি ও বাফেদা প্রতিদিনের বিনিময় হার ঠিক করে দেবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে মৌখিক সম্মতি নেবে। আগামী রবিবার (২৯ মে) থেকে নতুন এ নিয়ম কার্যকর করা হবে।
এদিকে এলসি বা ঋণপত্র খোলার সময় হারের সাথে খোলা বাজারে ডলার বিক্রির হারের পার্থক্য কমাতে ব্যাংকারদের টাকার আরও অবমূল্যায়নের আশ্বাস দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকাররা কতটুকু অবমূল্যায়ন চান এবিষয়ে তাদের প্রস্তাব কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাতে বলা হয়েছে।
বর্তমানে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কম হারে ডলার কিনলেও অনেক ব্যাংক ঋণপত্র খোলার জন্য উচ্চ হারে ব্যবসায়ীদের কাছে তা বিক্রি করছে। সরকারি ঋণপত্র হার ৮৭.৯০ টাকা হলেও, ডলারের ঘাটতির অজুহাতে ব্যাংকগুলো প্রতি ডলার ৯৫-৯৭ টাকায় আমদানি মূল্য নিষ্পত্তি করছে।
তবে রপ্তানি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে, রপ্তানিকারকদের তাদের ডলার আয়ের বিপরীতে আনুষ্ঠানিক হারই দিচ্ছে। ভোক্তারা যখন আমদানি-জনিত মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট; ঠিক তখনই কিছু ব্যাংক আমদানি ও রপ্তানি হারের পার্থক্য থেকে এভাবে ব্যবসা করছে।
ব্যাংকিং শিল্পের অভ্যন্তরীণরা বলছেন, স্থির ঋণের হারও ডলারের মূল্য নির্ধারণে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছে। এটি ডলার সংকটের মধ্যে ব্যাংকগুলিকে অযৌক্তিক ব্যবসা করতে প্ররোচিত করছে- কারণ তারা ক্রমবর্ধমান ঋণের চাহিদার সাথে ভারসাম্য বজায় রেখে ঋণের হার বাড়াতে পারেনি।
বৃহস্পতিবারের সভায় আরও ঠিক হয় যে, ব্যাংকগুলো মিলে ডলারের একক মূল্য নির্ধারণ করে দেবে; আর সেই দামে আসবে প্রবাসী আয়। ফলে কোনো ব্যাংকই বেশি দরে প্রবাসীদের পাঠানো ডলার কিনতে পারবে না।
সভাশেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজন অনুসারে তারল্য সমর্থন (ডলার বিক্রি) দেওয়া অব্যাহত রাখবে। রপ্তানিকারকদের তাদের অর্জিত আয় ডিলার ব্যাংক থেকেই নগদায়ন (টাকায় রুপান্তর) করতে হবে। ফলে মুদ্রাবাজারে স্থিরতা ফিরে আসবে।
নাম না প্রকাশের শর্তে সভায় উপস্থিত বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিবিএসকে বলেন, 'বৈঠকে আন্তঃব্যাংক বিনিময় হার নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত বর্তমান বিনিময় হার যৌক্তিক নয় বলে জানিয়েছে এবিবি ও বাফেদা।'
এবিষয়ে তাদের কাছে একটি প্রস্তাবনা চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বিনিময় হার নির্ধারণে সেই অনুসারে বিবেচনার আশ্বাসও দিয়েছে বলে জানান তিনি।
ডলার-টাকার একক বিনিময় হার নির্ধারণের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি- বিকেএমইএ'র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, এটি আরও আগেই করা উচিত ছিল। 'এতদিন ব্যাংকগুলো ভিন্ন ভিন্ন দামে ডলার বিক্রি করেছে, এটা নিয়ে আমাদের সমস্যা হচ্ছিল। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনেকবার বলেছি ব্যাংকগুলোকে একটা হার নির্ধারণ দেওয়ার জন্য।'
ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আরএফ হোসেন টিবিএসকে জানান, অভিন্ন ডলারের হার রবিবার থেকে কার্যকর হবে।
তিনি বলেন, 'মুদ্রাবাজারে স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা আনতে বেশকিছু পদক্ষেপ সভায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। সাময়িক কিছু অসুবিধা রয়েছে, তবে সেগুলি ধীরে ধীরে দূর হবে বলে আশা করছি।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয়।
২০০৩ সালের আগে দেশে একটি নির্ধারিত বিনিময় হার ছিল এবং ওই হারেই তখন ডলার কেনাবেচা চলতো উল্লেখ করে তিনি জানান, সব ব্যাংকের জন্য এক হার নির্ধারণ বর্তমান সংকটকালীন সময়ের জন্য সাময়িক ব্যবস্থা।
একক হারটি নির্ধারিত হলে, সেটি ডলার কেনা ও বেচা উভয় ক্ষেত্রেই করার পরামর্শ দেন এ অর্থনীতিবিদ। এছাড়া, কেনা ও বেচার মূল্য ব্যবধান যেন বেশি না হয়, সেজন্য একটি সীমা নির্ধারণের কথাও বলেন তিনি।
আমদানি ও রপ্তানিতে একক হার কোনো প্রভাব ফেলবে কিনা জানতে চাইলে সালেহউদ্দিন বলেন, 'খুব বেশি প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। যেহেতু ফিক্স করা হবে, একটু হাই রেটই করবে হয়তো। এতে এক্সপোর্টাররা কিছুটা সুবিধা পাবে এবং ইমপোর্ট কিছুটা কমতে পারে।'
একক হারের সিদ্ধান্ত ডলার বাজারের অস্থিরতা দীর্ঘমেয়াদে প্রশমণ করতে পারার সম্ভাবনা কম বলে মন্তব্য করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর। তিনি বলেন, মিয়ানমারে একটি আনুষ্ঠানিক বিনিময় হার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। কিন্তু খোলা মুদ্রাবাজারে কী হচ্ছে না হচ্ছে তার কোনো খবর তারা রাখে না।
তিনি প্রশ্ন রাখেন, 'বাংলাদেশের মতো একটি সম্প্রসারিত অর্থনীতিতে বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে কতদিন নির্দিষ্ট রাখা সম্ভব হবে?'
ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জারদের এখন এই একক হার অনুসরণ করতে হবে। এই সিদ্ধান্ত বাজার ও মূল্যস্ফীতির ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলে তাই এখন দেখার বিষয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে বৃহস্পতিবার খোলা মুদ্রাবাজারে আগের দিনের ৯৮.৫০ টাকা থেকে কমে ৯৭.৫০ বিক্রি হয়েছে ডলার। এদিন আন্তঃব্যাংক বিনিময় হার ৮৭.৯০ টাকায় অপরিবর্তিত ছিল।
চাপের মুখে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ
আমদানি বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে ডলারের দর, চাহিদা মেটাতে ডলার বিক্রিও করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ২৪ মে নাগাদ বিক্রি করেছে ৫৮০ কোটি ডলার। অথচ এর আগে ২০২১ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ৮০০ কোটি ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এরমধ্যেই, মহামারি পরবর্তী সময়ে আমদানি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে আরও বেশি অর্থ দিতে হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপের সম্মুখীন হচ্ছে।
বাংলাদেশের ফরেক্স রিজার্ভ গত বছরের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল, গত ২৫ মে নাগাদ তা ৪২.২৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে, রপ্তানি প্রায় ৩৩ শতাংশ বাড়লেও তা বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্যকে ধরে রাখতে পারেনি। এসময় ঘাটতি হয়েছে ২৫ বিলিয়ন ডলার। এটি আগের পুরো অর্থবছরের তুলনায় ৯ শতাংশ বেশি।
সাম্প্রতিক মাসগুলিতে রেমিট্যান্সে কিছুটা প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও ঘাটতি ১৪ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাওয়ায় দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের চলতি হিসাব উদ্বেগজনক অবস্থানে রয়েছে।