ভ্যাট ফাঁকির জরিমানা ও সুদে ছাড় আসতে পারে ব্যবসায়ীদের জন্য
সরকারের পাওনা পরিশোধে ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করতে আগামী বাজেটে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট)-এ অনিয়মের জরিমানা ও সুদ পরিশোধের ক্ষেত্রে ছাড় আসতে পারে। বর্তমানে যে কোন পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন হলে সমপরিমাণ জরিমানা গুনতে হয়। এই জরিমানার পরিমাণ অর্ধেক কমতে পারে। অন্যদিকে প্রতি মাসে ১ শতাংশ সুদের অর্থ ঠিক রেখে সময়সীমা কমিয়ে আনা অর্থাৎ ২৪ মাস বা ৩৬ মাস হতে পারে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বাজেট সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, জরিমানা ও সুদে ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে অর্থমন্ত্রীর আগামী ৯ জুনের বাজেটে তা উপস্থাপন হতে পারে।
বাজেট সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জরিমানা ও সুদের পরিমাণ অনেক সময় ফাঁকি কিংবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দাবিকৃত অর্থের সমান বা কখনো কখনো বেশিও হয়ে যায়। এক্ষেত্রে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান ভ্যাট পরিশোধ না করে আদালতে চলে যায়, যার ফলে এনবিআরের অর্থ আদায় ঝুলে যায়। সুদ ও জরিমানার পরিমাণ কম হলেও এনবিআর দাবিকৃত অর্থ সহজে ও দ্রুত পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। মূলত যারা প্রকৃত অর্থে ফাঁকিবাজ নন, কিন্তু জানার অভাবে কিংবা ভুলবশত বকেয়া হয়েছে – এমন ভ্যাটদাতা ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান সরকারের অর্থ পরিশোধে উৎসাহিত হবেন।
তবে এমন উদ্যোগ নেওয়া হলে ফাঁকিবাজ এবং যারা সরকারের রাজস্ব আটকে রাখতে চায় তারা উৎসাহিত হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন ভ্যাট বিভাগের কর্মকর্তারা।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরে কোন ভ্যাট ফাঁকির জরিমানা ২০০% বা দ্বিগুণ ছিলো। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে এসে তা ফাঁকির মূল্যের সমান বা শতভাগ করা হয়। বাজেট সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এবার তা ৫০% করা হতে পারে। অর্থাৎ ফাঁকি হওয়া মূল্যের অর্ধেক।
আর ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত ফাঁকি হওয়া অর্থ পরিশোধে প্রতি মাসে দুই শতাংশ সুদ দিতে হতো। গত অর্থবছর এসে তা ১ শতাংশ করা হয়। তবে যত লম্বা সময় যেত, সুদের পরিমাণও বাড়তে থাকতো। কোন কোন ক্ষেত্রে দাবিকৃত অর্থের বাইরে জরিমানা ও সুদ মিলিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিতে হতো। এবারের বাজেটে এই সময়সীমা কমানো হতে পারে।
এনবিআরের মাঠ পর্যায়ের ভ্যাট বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এই উদ্যোগের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি আছে। বাস্তবতা হলো, জরিমানা ও সুদের অর্থ মিলিয়ে টাকার অঙ্ক বেশি হলে তখন অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান টাকা দিতে চায় না। তারা তখন আদালতে চলে যায়, ফলে অর্থ আদায় ঝুলে যায়।
কিন্তু তার দাবিকৃত অর্থের তুলনায় জরিমানা ও সুদের পরিমাণ যদি কম হয়, তাহলে টাকা আদায় অপেক্ষাকৃত সহজ হয়।
ফাঁকিবাজ নন, কিন্তু অনেক সময় আইনগত কারণে বা অসচেনতার কারণে কারো কাছে ভ্যাট ডিমান্ড করা হয়। নতুন এ সিদ্ধান্ত বাজেটে কার্যকর হলে, তারা ওই অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে উৎসাহিত হবেন।
তবে যারা ফাঁকিবাজ, তারা এর সুবিধা নিয়ে বরং সরকারের অর্থ ঝুলিয়ে রাখার ক্ষেত্রে উৎসাহিত হতে পারেন।
ঢাকার একটি ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার টিবিএসকে বলেন, তার আওতাধীন এলাকায় দেশের নামকরা একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ৭০ কোটি টাকার ভ্যাটের ডিমান্ড নোটিশ জারি করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি আদালতে যায়। এ পর্যন্ত ৯৯ বার হিয়ারিং হয়েছে, কিন্তু রায় হয়নি।মামলাটি সাত বছর ধরে ঝুলে আছে।
তিনি জানান, এ ধরণের ইচ্ছাকৃতভাবে যারা ভ্যাটের টাকা ঝুলিয়ে রাখতে চায়, জরিমানা ও সুদে ছাড় দেওয়া হলে তারা বরং আরো উৎসাহিত হতে পারে।
ভ্যাট আইন বিশেষজ্ঞ এবং চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট ফার্ম, স্নেহাশিস মাহমুদ এন্ড কোম্পানির পার্টনার স্নেহাশিস বড়ুয়া বলেন, এক সময় ভ্যাটের জরিমানা দাবিকৃত অর্থের ৫০% ই ছিলো। পরবর্তীতে এটি বাড়িয়ে আবার কিছুটা কমানো হয়। আমরা আমাদের বাজেট প্রস্তাবে এটিকে আগের জায়গায় আনার কথা বলেছিলাম এবং সুদ পরিশোধের সময়ও কমানোর প্রস্তাব দিয়েছিলাম।
কেননা কখনো কখনো ব্যবসায়ীদের দাবিকৃত বা মূল এমাউন্টের চেয়ে সুদ ও জরিমানার অর্থ বেশি হয়ে যায়, যার কারণে তারা অর্থ পরিশোধে নিরুৎসাহিত হন। আমাদের প্রস্তাব আমলে নেওয়া হলে মামলার সংখ্যা কমবে।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, বর্তমান কঠিন পরিস্থিতি বিবেচনায় এ সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এ সুবিধা দেওয়া হলে অসৎ ব্যবসায়ীরা অনিয়মে উৎসাহিত হতে পারে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে এনবিআরের আওতাধীন অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনাল ও উচ্চ আদালতে বিভিন্ন মামলায় ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি এনবিআরের দাবিকৃত রাজস্ব আটকে রয়েছে। এর মধ্যে কোন কোন দাবিকৃত রাজস্ব ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে।