দেশে উৎপাদিত এপিআই’র বিক্রি-উৎপাদনে কর অব্যাহতি সুবিধা
ওষুধ তৈরির কাঁচামালের প্রাপ্তি সহজলভ্য করতে সরকার এবার দেশের অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) এর প্রস্তুতকারকদের বিক্রি বা সরবরাহ পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) অব্যাহতি দিতে যাচ্ছে।
আগামী বাজেটে এমন ঘোষণা আসতে পারে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। আগামী ৯ জুন সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশ করার সময় এ ছাড়ের ঘোষণা দিতে পারেন অর্থমন্ত্রী।
বর্তমানে, স্থানীয় এপিআই উৎপাদকদের বিক্রি বা উৎপাদন পর্যায়ে ১৫% ভ্যাট দিতে হয়।
এনবিআর সূত্র জানায়, এপিআই এবং ল্যাবরেটরি রিএজেন্টে স্বনির্ভরতা অর্জনে এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে এপিআই উৎপাদকদের জন্য রাজস্ব বোর্ড ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা নিয়ে এসেছে। তবে, এই সুযোগটি পেতে উদ্যোক্তাদের কিছু শর্ত মানতে হবে বলে উল্লেখ করেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সরকার দেশীয় উৎপাদকদের ভ্যাট অব্যাহতি দিলে স্থানীয় উৎপাদকরা প্রতযোগিতামূলক মূল্যে ঔষধ প্রস্তুতকারক কোম্পনিগুলোকে সরবরাহ করতে পারবে। কারণ একই ধরনের এপিআই আমদানি করতে গেলে তাদেরকে আমদানি পর্যায়ে ১৫% হারে ভ্যাট দিতে হয়
বর্তমানে একটিভ ফাইন কেমিক্যালস লিমিটেডের দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বেশকিছু ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানির কাঁচামালও তৈরি করে। তবে বাকি কোম্পানিগুলো শুধু নিজস্ব ব্যবহারের জন্যই মূলত ওই কাঁচামাল তৈরি করে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের মতে, দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্রায় ৭,০০০ কোটি টাকার কাঁচামালের চাহিদা আছে এবং এই বাজার বছরে ১২% হারে বাড়ছে। স্থানীয় কোম্পানিগুলো বর্তমানে ৪০০-৫০০ কোটি টাকার ফার্মাসিউটিক্যাল কাঁচামাল তৈরি করে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান, সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা দেওয়া হলে স্থানীয় বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে এবং রপ্তানিও বাড়বে।
সরকারের এই উদ্যোগকে 'ইতিবাচক পদক্ষেপ' হিসেবে দেখছেন অ্যাক্টিভ ফাইন কেমিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুর রহমানও।
তিনি উল্লেখ করেন, দেশের বাজার এখনো আমদানির নির্ভর হওয়ায় আর আন্তর্জাতিক বাজারেও এই পণ্যগুলোর ব্যাপক চাহিদা থাকায় এই খাতটির বৃদ্ধির বিপুল সম্ভাবনা আছে।
তিনি আরও বলেন, মহামারি চলাকালীন যখন চীন ও ভারতের কিছু কোম্পানি পণ্য সরবরাহ করতে পারছিল না, সে দুই বছরে তার কোম্পানি ফার্মাসিউটিক্যাল কাঁচামালের বিপুল সংখ্যক রপ্তানি আদেশ পেয়েছে।
ফার্মাসিউটিক্যাল খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ হিসেবে এপিআই খাতের বছরে ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
২০৩৩ সাল থেকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার 'মেধাস্বত্ব চুক্তি(ট্রিপস)' অনুযায়ী পেটেন্ট ছাড়ের সুবিধা পাবে না বাংলাদেশ।
এ কারণে গত কয়েক বছর ধরে এপিআইতে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার আলোচনা জোরালো হয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকারও সহযোগিতা দেওয়া বাড়াচ্ছে।
ন্যাশনাল অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রিডিয়েন্ট অ্যান্ড ল্যাবরেটরি রিএজেন্ট প্রোডাকশন অ্যান্ড এক্সপোর্ট পলিসি, ২০১৮ এর আলোকে ২০৩২ সালের মধ্যে ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে সরকার।
এ নীতিমালা অনুযায়ী, ২০১৯ সাল থেলে কাঁচামাল আমদানিতে ভ্যাট মওকুফ সুবিধা পাচ্ছে স্থানীয় এপিআই উৎপাদকরা।
কিছু শর্ত পূরণ সাপেক্ষে ২০৩২ সাল পর্যন্ত স্থানীয়ভাবে ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদন ও ব্যবসায় কর অব্যাহতির সুবিধা পাবেন স্থানীয় উৎপাদকরা।
এনবিআরের শর্তে বলা হয়েছে, সম্পূর্ণ কর অব্যাহতির সুবিধা পেতে হলে কোম্পানিগুলোকে প্রতি বছর ন্যূনতম পাঁচটি করে নতুন এপিআই মলিকিউল এবং ল্যাবরেটরি রিএজেন্ট স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করতে হবে। আর যেসব প্রতিষ্ঠান ন্যূনতম তিনটি পণ্য উৎপাদন করবে তাদের ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হারে করপোরেট কর দিতে হবে।
তবে, কেউ যদি ন্যূনতম শর্ত প্রতিপালনে ব্যর্থ হয় তাকে ৩০ শতাংশ হারে কর্পোরেট কর দিতে হবে এবং পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের করহার হবে ২২ দশমিক ৫ শতাংশ।
প্রস্তাবনায় আরো বলা হয়েছে, কোম্পানিগুলোকে বার্ষিক টার্নওভারের ন্যূনতম ১ শতাংশ বাধ্যতামূলকভাবে উন্নয়ন ও গবেষণা কাজে ব্যয় করতে হবে। আর এই বরাদ্দ বছর বছর বাড়াতে হবে। তবে কোনো প্রতিষ্ঠান যদি মানহীন কাঁচামাল উৎপাদনের জন্য সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক জরিমানার শিকার হয়, তবে ওই প্রতিষ্ঠান সেই বছরের অব্যাহতির সুবিধা পাবে না।
বিভিন্ন ওষুধের ক্ষেত্রে এপিআইয়ের খরচ ৩০ থেকে ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। বাংলাদেশ স্থানীয়ভাবে পূর্ণাঙ্গরূপে উৎপাদিত ৯৮ শতাংশ ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম।
পূর্ণাঙ্গরূপে উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও এপিআই ও অন্যান্য কাঁচামালের ৯০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। কাঁচামাল আমদানিতে অধিক নির্ভরতার কারণে ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এক্ষেত্রে সাপ্লাই চেইন এবং মূল্য নিয়ে বড় অনিশ্চয়তা কাজ করে।
বর্তমানে, স্কয়ার ফার্মা, বেক্সিমকো ফার্মা, একটিভ ফাইন কেমিক্যালস লিমিটেড, এসিআই লিমিটেড, গ্লোব ফার্মা, গণস্বাস্থ্য ফার্মা, অপসোনিন ফার্মা, ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল এবং এসকায়েফসহ স্থানীয় ১৫ টি প্রতিষ্ঠান ৪০ শতাংশ পর্যন্ত এপিআই উৎপাদন করে। এদের মধ্যে কেবল এক্টিভ ফাইন কেমিক্যালস লিমিটেড পুঁজিবাজারের অন্তর্ভুক্ত যা কোনো সম্পূর্ণ ওষুধ উৎপাদন করে না। গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস একাই স্থানীয়ভাবে ৬০ শতাংশ এপিআই উৎপাদন করে।
আমেরিকান বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান আইকিউভিআইএ-র মতে, দেশের ফার্মাসিউটিক্যাল বাজারের মূল্য ২০২০ সালে ১০ শতাংশের বেশি বার্ষিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে ২৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকার মেডিসিন রপ্তানিও করে থাকে। তবে, দেশের শীর্ষস্থানীয় ১০টি প্রতিষ্ঠান মোট ওষুধের ৭১ শতাংশ বিক্রি করে।