ডিমভাজি এখন ২০ টাকা! নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস দরিদ্রদের
কারওয়ানবাজারের কিচেন মার্কেটের মুরগির দোকানগুলোর ঠিক উল্টোদিকে ছোট্ট একটি হোটেল, তিনটি টেবিল সেখানে আঁটোসাঁটো পাতা। বাজারটির বিভিন্ন পণ্যের বিক্রেতা ও দিনমজুর মানুষগুলো এই হোটেলের ক্রেতা। হোটেলটিতে একটি ডিমভাজি খেতে খরচ করতে হচ্ছে ২০ টাকা। সাথে পরোটা নিলে মোট বিল আসছে ৩০।
খেতে খেতে ফল বিক্রেতা আব্দুর রহমান টিবিএসকে জানালেন, 'আগে ডিমভাজির দাম ছিল ১৫ টাকা, কয়েকদিন ধরেই ২০ টাকা নিচ্ছে। পরোটার সাইজও কিছুটা ছোট হয়ে গেছে।'
হোটেলের বিক্রেতা মো. জলিল জানালেন, 'দেড়শ টাকার তেল এখন দুইশ টাকায় কিনতে হচ্ছে, ডিম, ময়দা সবকিছুর দামই বেড়েছে। আমাদের দাম না বাড়িয়ে উপায় নেই।'
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে ক'দিন ধরেই সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম বৈশ্বিক ও স্থানীয় বাজারে হু হু করে বাড়ছে। এই দৌড়ে ডিমও পিছিয়ে নেই। একেক হালি ডিমের দাম ৩৫ টাকা থেকে বেড়ে এখন ৪০-৪২ টাকা। ডজন কিনতে গেলে গুনতে হচ্ছে ১২০-১২৫ টাকা।
বিভিন্ন পেশার নিম্ন আয়ের বেশকিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মাছ-মাংসের চড়া বাজারে একটু ডিম দিয়ে ভাত-রুটি খাওয়ার স্বস্তিটাও এখন আর নেই।
চালের দাম ক'দিন ধরেই বাড়তি, ভরা মৌসুমে সব ধরনের চালেই কেজিতে দুই-চার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। নাজিরশাইল চালের দাম উঠেছে ৬৮-৭৫ টাকা। মিনিকেট চাল আগে ৫৮-৫৬ টাকায় পাওয়া যেত। এখন সেটা ৬২-৬৮ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। আর মোটা চালের দাম ৪৫-৪৬ টাকা থেকে বেড়ে ৫০ টাকায় উঠেছে।
বেসরকারি এক চাকরিজীবি রাহেনুর রহমান কিছুটা সাশ্রয়ী মূল্যে চাল কিনতে বুধবার এসেছিলেন কারওয়ানবাজারে। আল্লাহর দান রাইস এজেন্সিতে বিক্রেতা মিনিকেট চালের দাম ৬৬ টাকা শুনেই চলে যাচ্ছিলেন। বিক্রেতা জানালেন, 'ভাই চালের দাম সব জায়গায় বাড়তি, এর চেয়ে কমে কেউ দিতে পারবে না।'
রাহেনুর রহমান জানান, তিনি থাকেন রাজধানীর মধুবাগ এলাকায়। বাসার পাশের দোকানি মিনিকেট চাল ৬৮ টাকা চাওয়ায় তিনি কারওয়ানবাজার থেকে কিনতে এসেছিলেন। একমাস আগেও এই চাল তিনি ৬৩ টাকায় কিনেছিলেন।
ভাতের খরচ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এবারে বাড়তে শুরু করেছে আটার দাম। এক কেজির প্যাকেটের দাম ৪৫ টাকা থেকে বেড়ে ৫০ টাকা হয়েছে।
খোলা আটার দাম একমাস আগেই ছিল ৩৪-৩৬ টাকা। দুই দফায় দাম বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৪-৪৬ টাকায়। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর বাজার বিশ্লেষণের তথ্য বলছে, এক মাসের ব্যবধানে খোলা আটার দাম বেড়েছে ২৮.৫৭ শতাংশ।
পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, ১৭৫০ টাকার আটার ৫০ কেজির বস্তা এখন ২১৫০ টাকা। রাশিয়া, ইউক্রেন ও ভারত থেকে গম আমদানি বন্ধের প্রভাবে হু হু করে বাড়ছে আটার দাম।
যদিও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলছেন, ভারত থেকে জিটুজি পদ্ধতিতে সরকার গম আমদানি করতে পারবে।
ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়ে সরকারই নতুন দর নির্ধারণ করে দিয়েছে। যা এখন বিক্রি হচ্ছে ১৮২ টাকা থেকে ১৯৮ টাকায়। বেকারি পণ্যের দাম আগেই ৫-১০ শতাংশ বেড়েছে। ২৫০ গ্রামের পাউরুটির প্যাকেট ৩৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকায় বিক্রি করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এই দাম আরও বেড়ে যাবে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।
ভারত থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার কারণে পেঁয়াজের দাম ৩০-৩৫ টাকা বেড়ে এখন ৪০-৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও সরকার বলছে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতেই আমদানি নিয়ন্ত্রণ করছে সরকার।
বাজারের এই অবস্থার মধ্যে সরকার টিসিবির মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যের তেল, ডাল, চিনি ও পেঁয়াজ বিক্রির কার্যক্রম শুরুর ঘোষণা দিয়েও পরে তা বন্ধ করে দিয়েছে। এতে করে ভোগান্তিতে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষেরা।
এই অস্থিরতার মধ্যে কিছু মানুষ ব্যবহার্য খরচ ও খাওয়ার খরচ সংকুচিত করে ফেলছে। বেসরকারি চাকরিজীবী তৌহিদুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'সবকিছুর দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে করে ভবিষ্যতে অবস্থা আরও ভয়াবহ হতে পারে। যে কারণে বাসায় অতিরিক্ত ভাজাপোড়া পরিহার করে তেলের খরচ কমানো, যতটা প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই রান্না করা, তিন চার পদের খাবারের জায়গায় এক-দুই পদে নিয়ে আসার মতো পদক্ষেপ নিচ্ছি।'
ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এখান থেকে খরচ কমিয়ে বাড়তি কিছু টাকা জামানোর চেষ্টা করছেন বলেও জানান তিনি।
এদিকে খাবারের বাইরেও নিত্যব্যবহার্য পণ্য যেমন গুঁড়া সাবান, কাপড় কাচা সাবান, গায়ে মাখা সাবান, শ্যাম্পু, টুথপেস্ট সহ বিভিন্ন পণ্যের দামও ঊর্ধ্বমুখী।