ভোজ্যতেলের মূল্য বৃদ্ধির বড় ধাক্কা প্রাণীখাদ্য শিল্পে
সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার ধাক্কা লেগেছে দেশের পশুখাদ্য শিল্পে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সয়া মিলের ওপর এ শিল্প ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। সয়াবিন বীজ নিষ্কাশনের মাধ্যমে তেল উৎপাদনের সময় বাই-প্রডাক্ট হিসেবে পাওয়া যায় এই সয়া মিল।
বর্তমানে সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পনিগুলো চাইলেই স্থানীয় বাজারে দাম বাড়াতে পারছে না।
কিন্তু তেল উৎপাদনকারীরা প্রাণীখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত সয়া মিলের দাম লাগামহীনভাবে বাড়িয়ে প্রাণিখাদ্যের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এর প্রভাবে বেড়ে যাচ্ছে মাছ, মাংস, দুধ, ডিমের উৎপাদন ব্যয়। ফলে এসব পণ্যের দামও বাড়ছে।
শনিবার ফিড ইন্ডাষ্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (এফআইএবি) আয়োজিত এক ভার্চুয়াল মতবিনিময় সভায় প্রাণীখাদ্যের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে কীভাবে পোল্ট্রি, মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা তুলে ধরা হয়।
ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠনের নেতারা বলছেন, ফিড তৈরিতে ৫০-৫৫ শতাংশ ভুট্টা ও ৩০-৩৫ শতাংশ সয়াবিন মিল ব্যবহার করা হয়। করোনা শুরুর পর থেকে গত দুই বছরে সয়াবিন মিলের দাম ৮৮ শতাংশ বেড়েছে। যেখানে সর্বশেষ কয়েক মাসেই এই দাম ৩০ শতাংশ বেড়েছে এবং ভুট্টার দাম বেড়েছে ১৮ শতাংশ।
এফআইএবির সাধারন সম্পাদক মো. আহসানুজ্জামান বলেন, গত বছরের আগস্টে সয়াবিন মিলের দাম ছিল প্রতি কেজি ৫৪ টাকা, চলতি বছরের শুরুতে তা করা হয় ৬০ টাকা।
এরপর গত ১৬ মার্চে ডিও (ডেলিভারী অর্ডার) মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৭০ টাকা। অথচ ভোজ্য তেল আমদানিতে সরকার ১০ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ছাড় দিয়েছে। দেশের বাজারে সয়াবিন মিলের দাম যে পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়েও অনেক বেশি।
আহসানুজ্জামান দাবি করেন, সরকারের পক্ষ থেকে সয়াবিন তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে ভোজ্য তেল উৎপাদন ও পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোকে যখন চাপ দেয়া হচ্ছে, তখন তারা তেলের দাম কিছুটা কমিয়ে সয়াবিন মিলের দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে দিয়েছে।
সংগঠনের নেতাদের দাবি, হাতেগোনা ৩-৪টি সিড ক্র্যাশিং কোম্পানির কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশের পোল্ট্রি, মৎস্য ও ডেইরি খাত। তাই এ বিষয়ে নজরদারিতে সরকারের গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কারণ ডিম, দুধ, মাছ, মাংসের উৎপাদন খরচ বাড়লে তার ভার সাধারন ভোক্তাদের কাঁধে গিয়েই পড়বে।
করোনা মহামারি ও সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে গত দুই বছরে পশুখাদ্য খাদ্য তৈরির বিভিন্ন উপাদানের দাম ৮৮ থেকে ১২৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এই চাপ সামাল দিয়ে বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসান গুনছে, আর লোকসান কমিয়ে আনতে গিয়ে উৎপাদন কমিয়ে দিতে হচ্ছে বলে জানান খাত সংশ্লিষ্টরা।
এফআইএবির সভাপতি এহতেশাম বি শাহজাহান বলেন, ফিড মিলারদের ধারণা ছিল কাঁচামালের দর সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে। কিন্তু তা হয়নি, উল্টো প্রতিদিনই দাম বাড়ছে।
বর্তমানে কাঁচামালসহ মোট উৎপাদন খরচ এতটাই বেড়েছে যে প্রতি কেজি ব্রয়লার ফিডে ৩-৪ টাকা, লেয়ার ফিডে ২.৫০-৩.৫০ টাকা, ক্যাটেল ফিডে ৩.৫০-৪ টাকা, ভাসমান ফিশ ফিডে ৪-৫ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।
ইহতেশাম বলেন, বড় ফিড মিলগুলো তাদের উৎপাদন ১৫-২০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। বেশ কিছু ছোট মিল এবং অনেক ব্রয়লার খামার ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।
ফিডের মূল্যবৃদ্ধিতে প্রোটিন উৎপাদনের যে খরচ ও বাজারে যে মূল্য, তার সঙ্গে সমন্বয় না থাকায় পোল্ট্রি, মৎস্য ও ডেইরি খামারিদের মধ্যেও সংকট তৈরি হচ্ছে। ফলে অনেকেই ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছে বলে জানান তিনি।
এফআইএবি'র সাধারণ সম্পাদক মো. আহসানুজ্জামান বলেন, ফিড তৈরিতে যে পরিমাণ খরচ হয় তার প্রায় ৮০ শতাংশই হয় কাঁচামাল ক্রয় বাবদ।
২০২০ সালের মার্চে প্রতি কেজি ভুট্টার দাম ছিল ২৪.১৭ টাকা। চলতি মাসে তা বেড়ে হয়েছে ৩৬ টাকা। ৩৭.২৫ টাকার সয়াবিন মিলের দাম এখন ৭০ টাকা বলে জানান তিনি।
৩৮.৫০ টাকার ফুল-ফ্যাট সয়াবিনের দাম এখন প্রায় ৬৬.৯০ টাকা। ২১.২৫ টাকার রাইস পলিশ কিনতে হচ্ছে ৩৬.৩৩ টাকায়।
একইভাবে ১৩৩.৩৩ টাকার এল-লাইসিন ২০০ টাকা, ২০০ টাকার ডিএলএম ৩০০ টাকায়, ৫৪ টাকার পোল্ট্রি মিল ৮০ টাকায় এবং ১০০ টাকার ফিশ মিল ১৪৬ টাকায় কিনতে হচ্ছে বলেও জানান আহসানুজ্জামান।
এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে আসন্ন জাতীয় বাজেটে পোল্ট্রি, মৎস্য ও পশুখাদ্য তৈরিতে ব্যবহৃত সব ধরনের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে সব ধরনের আগাম কর (এটি), অগ্রিম আয়কর (এআইটি), উৎস কর (সোর্স ট্যাক্স), ভ্যাট ও শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানান খাত সংশ্লিষ্টরা।