গ্যাস সংকট: কারখানা বন্ধ করার কথা ভাবছেন উদ্যোক্তারা
অপর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহের কারণে কারখানা বন্ধের বিবেচনা করছেন অনেক মালিকই। গ্যাস সংকটের সমাধান চেয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দীর্ঘ দিন ধরে দেনদরবার করলেও এখনো কোনো সমাধান মেলেনি। ফলে এই পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছেন তারা।
লিটল স্টার গ্রুপের মালিকানাধীন সাভারের লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেড এর অনুমোদিত গ্যাসের প্রেশার ১০ পিএসআই হলেও দিনের বেলায় বেশিরভাগ সময়ই তা ২ থেকে ৩ পিএসআই মধ্যে থাকে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবারও তা ২ এর নিচে নেমে আসে।
গ্যাস সংকটের কারনে উৎপাদন বন্ধ রাখা, পণ্যের মান খারাপ হওয়া ও দামি মেশিনারির ক্ষতি হওয়াসহ গত চার বছরে প্রায় ১৪৫ কোটি টাকার উৎপাদন লোকসান হয়েছে এই কোম্পানির।
দুই সপ্তাহ আগেই প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের কাছে সমাধান চেয়ে চিঠি দিয়েছেন।
এছাড়াও কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)-এর কাছে চিঠি পাঠিয়ে উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধও জানিয়েছেন।
খোরশেদ আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা আর পারছি না। সম্ভবত কারখানাটি বন্ধই করে দিতে হবে।"
কেবল লিটল স্টার স্পিনিং নয়, টেক্সটাইল ছাড়াও গ্যাস নির্ভর এ খাতের ডায়িং, ফিনিশিং, প্রিন্টিং পোশাকসহ অন্যান্য খাতের বেশ কিছু ইউনিট অনেকদিন ধরেই এই সমস্যার সম্মুখীন হয়ে আসছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে কম বেশি এই সমস্যা থাকলেও গাজীপুর ও মানিকগঞ্জ এলাকায় তা অপেক্ষাকৃত বেশি। তাছাড়া সমস্যা রয়েছে নারায়নগঞ্জেও।
এর মধ্যে কতিপয় কারখানা বিকল্প উপায়ে কিছু সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে, নয়তো একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য উৎপাদন বন্ধ রাখা কিংবা কমিয়ে দিতে হচ্ছে।
তবে পেট্রোবাংলা ও তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড জানিয়েছে, সামিট এফএসআরইউর ক্ষতিগ্রস্ত পাইপলাইন এখনো মেরামত না হওয়ায় সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও এক মাস সময় লাগবে।
এদিকে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান টিবিএসকে জানান, কক্সবাজারের মহেশখালীতে এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট বন্ধ হওয়ায় সরবরাহ কমে যায়। ফলে তারা বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের নিম্নচাপ লক্ষ্য করেছেন।
নাজমুল আহসান বলেন, "আশা করছি ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে এফএসআরইউর ক্ষতি মেরামত করা হবে এবং আমরা ওই মাসের মধ্যে গ্যাস সরবরাহ করতে পারব।"
এদিকে বিভিন্ন শিল্পে ক্রমবর্ধমান গ্যাসের চাহিদা মেটাতে জাতীয় গ্যাস গ্রিডে এলএনজি আমদানি ও সরবরাহের জন্য মহেশখালীতে দুটি ভাসমান স্টোরেজ এবং রি-গ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) স্থাপন করে সরকার।
২ হাজার ৫০০ এমএমসিএফ গ্যাসের স্থানীয় উৎপাদনের পাশাপাশি, দুটি এফএসআরইউএস প্রতিদিন ৬৫০ এমএমসিএফ গ্যাস সরবরাহ করতো।
কিন্তু গত বছরের ১৮ নভেম্বর মুরিং পাইপলাইনে ক্ষতির কারণে সামিট গ্রুপের মালিকানাধীন ও পরিচালিত একটি এফএসআরইউ এলএনজি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।
সামিট এফএসআরইউ বন্ধের কারণে দেশের গ্যাস সঞ্চালন লাইনে প্রায় ১৫০ এমএমসিএফ থেকে ২০০ এমএমসিএফ গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে।
পরবর্তীকালে, তিতাস গ্যাসের বিতরণ এলাকায়ও গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক সময়ের ১ হাজার ৮০০ এমএমসিএফ থেকে কমে ১ হাজার ৫১৮ এমএমসিএফ-এ নেমে আসে।
এক বিজ্ঞপ্তিতে তিতাস গ্যাস জানিয়েছে, ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের নিম্নচাপ লক্ষ্য করা যাবে।
এ বিষয়ে আঞ্চলিক বিপণন বিভাগ-গাজীপুরের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ইঞ্জিনিয়ার মোঃ কামরুল হাসান টিবিএসকে জানান, ভোক্তাদের কাছ থেকে কোনো অভিযোগ পেলেই তারা চাপের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন।
বিটিএমএ সূত্র জানিয়েছে, অন্তত চারটি প্রতিষ্ঠান তীব্র গ্যাস সংকটে উৎপাদনে ক্ষতির কথা জানিয়েছে চিঠি পাঠিয়েছে। লিটল স্টার স্পিনিং লিমিটেড ছাড়াও এ তালিকায় রয়েছে মোশারফ কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, এপেক্স উইভিং মিলস ও হোমটেক্সটাইল।
এর বাইরে ওফাজউদ্দিন স্পিনিং মিলস লিমিটেড, মিথেলা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, এম. হোসেন স্পিনিং মিলস, আবেদ টেক্সটাইল প্রসেসিং মিলস, এম এ এইচ স্পিনিং মিলস লিমিটেড, আলহাজ টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, রাইজিং স্পিনিং মিলস, আকিজ টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, মুন্নু টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড বড় ধরণের গ্যাসের সংকটের সম্মুখীন বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, দীর্ঘ আলোচনার পরও সমাধান না হওয়ায় এখন আর অনেকে ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে সমস্যার কথা জানাতেও চান না।
আবেদ টেক্সটাইল প্রসেসিং মিলস লিমিটেডের একজন পরিচালক ও বিটিএমএর ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ আল মামুন টিবিএসকে বলেন, "গ্যাস সংকটের কারনে দুটি ইউনিটের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে একটি ইউনিট প্রায় বন্ধই রাখতে হচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি।"
গত কয়েক মাস আগে গাজীপুর, নারায়নগঞ্জের কিছু এলাকা গ্যাস সংকট তীব্র হওয়ার পর এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। তবে সম্প্রতি কিছু এলাকায় ফের সমস্যা তৈরি হয়েছে।
উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাঝে মাঝে হয়তো পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। আবার আগের অবস্থায় চলে যায়।
সংকট কাটাতে ব্যাপকভাবে এলএনজি আনার কথা বলা হলে তাতেও অগ্রগতি নেই।
শিল্পোদ্যোক্তারা জানান, টেক্সটাইল শিল্প তুলনামূলক বড় বিনিয়োগের। গ্যাস সংকটের কারনে উৎপাদন ব্যহত হলে আর্থিক ক্ষতি বাড়তে থাকলে তাদের ব্যাংক ঋণ পরিশোধে সমস্যা দেখা দেবে।
মিথেলা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোঃ আজহার খান টিবিএসকে বলেন, নারায়নগঞ্জের আড়াইহাজারে তার এ কারখানায় ১৫ পিএসআই প্রেশারের অনুমোদন থাকলেও বেশিরভাগ সময়ই এক থেকে দুই পিএসআই প্রেশার থাকে। সর্বোচ্চ প্রেশার ৮ থেকে ১০ পিএসআই পর্যন্ত পাওয়া যায়। অন্যদেরও একই অবস্থা।
উৎপাদনের ক্ষতির বর্ননা দিয়ে তিনি বলেন, "একবার গ্যাসের প্রেশার চলে যাওয়ার ফেব্রিক্সের সিনক্রোনাইজ করে ফের চালু করতে পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা সময় লাগে। মেশিনের লেংথে থাকা হাজার হাজার গজ কাপড় নষ্ট হয়।"
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, "ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ হয়ে গেলে 'তাদের' (কর্তৃপক্ষ) তো কোন সমস্যা নেই।"
হঠাৎ গ্যাসের প্রেশার কমে যাওয়ায় ডায়িংয়ে থাকা কাপড়ের রংয়ের হেরফের হওয়ায় ওইসব কাপড়ও ডিসকালার হয়ে যায় বলে জানান দেশের অন্যতম বৃহৎ টেক্সটাইল মিল মোশাররফ কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশাররফ হোসেন।
তিনি তার উৎপাদনের কিছু অংশ নিজস্ব উপায়ে চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে জানান।
সমস্যা নিয়ে কয়েক দিন আগেও তিতাত গ্যাস কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, "তারা কোন সমাধান দিতে পারছে না। আমার সঙ্গে ১৫ পিএসআই-এর চুক্তি হলেও তা আমাকে দেওয়া হচ্ছে না। তাহলে আমার ব্যাংক ঋণের টাকা কে দেবে?"
এদিকে মোহাম্মদ হাতেম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা যখন ৭.৬২ টাকা করে প্রতি ইউনিটের বিল দিতাম তখন বিল বাড়ানো হলো এবং বলা হলো এলএনজি ন্যাশনাল গ্রিডে ঢুকবে, ফলে গ্যাসের সংকট থাকবে না। এখন ইউনিট প্রতি ১৩.৫ টাকা বাড়তি বিল দিচ্ছি কিন্তু গ্যাসের সংকট কাটেনি।"
তিনি জানান, নারায়নগঞ্জের বেশিরভাগ এলাকায় ১৫ পিএসআই গ্যাসের প্রেশারের অনুমোদন থাকলেও ৫ পিএসআই'র বেশি পাওয়া যায় না।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, চাওয়ার পরেও তারা ইভিসি মিটার পান না।
গ্যাস সংকটের জন্য উদ্যোক্তারা তিতাস কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনাকেও দায়ী করছেন উদ্যোক্তারা।
লিটল স্টারের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম জানান, তিনি ৩ কোটি টাকা খরচে নিজের কারখানা পর্যন্ত গ্যাসের লাইন নিয়েছেন।
"কিন্তু তিতাস কর্তৃপক্ষ মাঝপথে অন্তত ৫টি কারখানাকে ওই লাইন থেকে সংযোগ দিয়েছে। ফলে আমি কারখানায় গ্যাসের প্রেশার পাই না," বলেন তিনি।