ওয়ালমার্ট, এইচএন্ডএমের ব্যবহৃত হ্যাঙ্গার আমদানি করতে চায় প্রাণ-আরএফএল
প্লাস্টিক বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করার নিজস্ব কোন ব্যবস্থা না থাকায় তা বাংলাদেশে রপ্তানি করতে চায় ওয়ালমার্ট, কেয়ারফোর, এইচএন্ডএমের মতো ইউরোপ, আমেরিকার ডজনখানেকের বেশি ব্র্যান্ড। তাদের কাছ থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য আমদানি করে বাংলাদেশে পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে তাই আবার রপ্তানি করতে চায় প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের শতভাগ রপ্তানিমুখী একটি প্লাস্টিক উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠান হলো বঙ্গ প্লাস্টিক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কাছে প্লাস্টিক হ্যাঙ্গার রপ্তানি করে।
এই হ্যাঙ্গারগুলো যখন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পরে তখন সেগুলো ফেলে দিতে হয়। কিন্তু এসব উন্নত দেশের ব্যবস্থাপনা অনেক বেশি সুসংবদ্ধ হওয়ায় যেখানে-সেখানে বর্জ্য ফেলতে পারে না। তাদের পুনঃপ্রক্রিয়ারও কোন ব্যবস্থা নেই। সে কারণে তারা এসব আবার বাংলাদেশের কাছেই রপ্তানি করতে চায়।
ব্র্যান্ডগুলোর আগ্রহের প্রেক্ষিতে প্রাণ-আরএফএল এগুলো পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করার জন্য বাংলাদেশে আমদানি করতে চায়। আমদানির অনুমতির জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদনও করা হয়েছে বঙ্গ প্লাস্টিক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের পক্ষ থেকে।
প্রাণ-আরএফএল বলছে, ব্র্যান্ডগুলো পণ্য বিক্রির পর তাদের প্লাস্টিক হ্যাঙ্গারগুলো অভঙ্গুর ও অক্ষত অবস্থায় রেখে দেয় যা পুনরায় ব্যবহারযোগ্য। প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থানীয়ভাবে পণ্যটির পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের ব্যবস্থা নেই। যে কারণে তারা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রাণ-আরএফএলের কাছে তাদের ব্যবহৃত প্লাস্টিক হ্যাঙ্গারগুলো রপ্তানির আগ্রহ দেখিয়েছে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল টিবিএসকে বলেন, "আমরা প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করি, আমাদের কারখানা রয়েছে। এজন্য প্রচুর কাচামালও দরকার। সেক্ষেত্রে আমরা যদি সস্তায় কাচামাল আনতে পারি তাহলে পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে আবার রপ্তানি করতে পারবো।"
প্রাণ-আরএফএল দাবি করছে, প্লাস্টিকের হ্যাঙ্গারগুলো পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করে আবার এসব ব্র্যান্ডের কাছেই বিক্রি করা হবে। এতে করে পরিবেশের উপর কোন ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবেনা।
প্লাস্টিকের ঊর্ধ্বমুখী চাহিদা এবং পুনঃব্যবহারের হার কম থাকায় বিশ্বব্যাপী পরিবেশের উপর একটি চরম নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে। ফলে প্রাণ-আরএফএল প্লাস্টিক পণ্যের পুনঃব্যবহারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় তারা প্লাস্টিক বর্জ্য আমদানি করছে।
এসব দিক বিবেচনা করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে হ্যাঙ্গার আমদানির অনুমতি চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশে প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে প্রায় ৪ হাজার। দেশে প্রতি বছর প্রায় ২৪ লাখ টন প্লাস্টিক ব্যবহার হচ্ছে। মাথাপিছু প্রায় ১৫ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহার করছে বাংলাদেশের মানুষ। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মেট্রিক টনের বেশি প্লাস্টিক উৎপাদিত হচ্ছে। উন্নত দেশগুলোতে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার প্রায় ৬০ কেজি।
এর মধ্যে শিল্প গ্রুপ প্রাণ-আরএফএল প্রতিবছর প্রায় তিন লাখ মেট্রিক টন প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন করে থাকে। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে গৃহাস্থালি পণ্য, পাইপ ও ফিটিংস, গার্মেন্টস এক্সেসরিজ ও খাদ্যপণ্যের প্যাকেজিং। গ্রুপটি ২০১২ সাল থেকে প্লাস্টিক পণ্য রিসাইক্লিং কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত।
প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় বাজার থেকে পুরনো প্লাস্টিক সংগ্রহ করে প্রতি বছর ৩০ হাজার মেট্রিক টন প্লাস্টিক রিসাইক্লিং করছে। এর মধ্যে মগ, বদনা, বালতি, পিইটি বোতল, চেয়ার থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্লাস্টিক রিসাইক্লিং করছে প্রতিষ্ঠানটি।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০টি সংগ্রহ কেন্দ্র রয়েছে। এসব সংগ্রহ কেন্দ্রে 'ব্যবহৃত প্লাস্টিক' চূর্ণ করে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের নিজস্ব কারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কসহ প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের তিনটি কারখানায় প্লাস্টিক রিসাইক্লিং করা হয়।
'ব্যবহৃত প্লাস্টিক' সংগ্রহের পরে প্রক্রিয়াজাত করে বিন, গার্ডেনিং, গৃহস্থালি, পোল্ট্রি আইটেম ও ব্যাগসহ প্রায় ১০০ ধরনের পণ্য তৈরি করা হয়। প্লাস্টিক রিসাইক্লিং খাতে গ্রুপটির এ পর্যন্ত মোট বিনিয়োগ প্রায় ৩২০ কোটি টাকা।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ প্রতিবছর প্রায় ৩০,০০০ মেট্রিক টন 'ব্যবহৃত প্লাস্টিক' থেকে প্রায় ২৭,০০০ মেট্রিক টন কাঁচামাল উৎপন্ন করে। আমদানি করলে এ পরিমাণ কাঁচামালের আর্থিক মূল্য প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।
'ব্যবহৃত প্লাস্টিক' নিয়ে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ভবিষ্যতে ব্যাপক পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে গ্রুপটি তার মোট প্লাস্টিক ব্যবহারের প্রায় ১০ ভাগ রিসাইক্লিং করে থাকে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে গ্রুপটির পরিকল্পনা রয়েছে মোট ব্যবহারের প্রায় ২০ ভাগ রিসাইক্লিং করা। তাছাড়া খুব শীঘ্রই আরো নতুন ১০টি সংগ্রহকেন্দ্র করা হবে। ভবিষ্যতে পণ্যের সংখ্যা আরো বাড়ানো হবে।
রিসাইক্লিং এর একটি বড় খাত হতে পারে ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্যাকেজিং, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পিইটি বোতল। প্রাণ-আরএফএল এখন পিইটি বোতলকে ফ্লেক্স করে চীনে রপ্তানি করে। যদি পিইটি বোতলকে রিসাইক্লিং করে পলিস্টাইরিন থ্রেড তৈরি করা এবং সেটি থেকে ফেব্রিক তৈরি সম্ভব হতো, তাহলে বর্তমানে পোশাক খাতে যে বিপুল পরিমাণ পলিস্টাইরিন ফেব্রিক আমদানি হচ্ছে, সেটি করা লাগতো না। এর ফলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হতো।
পিইটি বোতল এবং পিইটি জাতীয় প্যাকেজিং এর ব্যাপক ব্যবহার হয় বাংলাদেশে। এ ভাবনা থেকে প্রাণ-আরএফএল এ খাতে আগামী দুই বছরের মধ্যে পিইটি বোতলের রিসাইক্লিং প্লান্ট করার পরিকল্পনা করছে, যেখানে ফেব্রিক পর্যন্ত করা যাবে। এর ফলে পরোক্ষভাবে পরিবেশের ব্যাপক উপকার হবে এবং এ খাতকে বিকশিত করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।