আখাউড়া স্থলবন্দর: আয় বাড়লেও পিছিয়ে বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন
দীর্ঘদিন পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে পুরোদমে ভারত থেকে পণ্য আমদানি শুরু হয়েছে। রপ্তানির বিপরীতে আশানুরূপ হারে পণ্য আমদানি হওয়ায় করোনা মহামারির মাঝেও চাঙ্গাভাব বিরাজ করছে দেশের অন্যতম বৃহৎ এ স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে। এতে করে বন্দরের আয়ও বাড়ছে। কিন্তু দেশের অন্য স্থলবন্দরগুলোর তুলনায় অবকাঠামোগত উন্নয়নে এখনও পিছিয়ে রয়েছে আখাউড়া স্থলবন্দর। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় অনেক কিছুরই সংকট রয়েছে বন্দরে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১০ সালের ১৩ আগস্ট স্থল শুল্ক স্টেশন থেকে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আখাউড়া স্থলবন্দর। তার আগে ১৯৯৪ সাল থেকে স্থল শুল্ক স্টেশন দিয়ে ভারতে পণ্য রপ্তানি হতো। তবে ভারত থেকে প্রসাধনী সামগ্রীসহ উচ্চ চাহিদা সম্পন্ন পণ্য আমদানির অনুমতি না থাকায় বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানিতে অনীহা ছিল ব্যবসায়ীদের। যদিও বছরে দুই-একবার শুটকি ও ফুলঝাড়ুসহ কিছু পণ্য আমদানি হতো ভারত থেকে।
বর্তমানে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৪-৫ কোটি টাকা মূল্যের হিমায়িত মাছ, রড, সিমেন্ট, ভোজ্য তেল, তুলা ও ফলমূলসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি হচ্ছে ভারতে। দীর্ঘদিন পর গত আগস্ট মাস থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি শুরু হয়েছে। এখন নিয়মিত চাল ও গম আসছে ভারত থেকে। ফলে করোনা মহামারির মাঝেও বন্দরের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে চাঙ্গাভাব বিরাজ করছে। এতে করে আগের তুলনায় স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের আয়ও বাড়ছে।
স্থলবন্দর সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে গত জুলাই মাসে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়েছে ৫০০ ট্রাক পণ্য। এর বিপরীতে ভারত থেকে আমদানি হয়েছে মাত্র ১ ট্রাক পণ্য। আগস্ট মাসে ৮৬৫ ট্রাক পণ্য ভারতে রপ্তানি এবং বিপরীতে আমদানি হয় ৫৩৪ ট্রাক পণ্য। সেপ্টেম্বর মাসে ৯০১ ট্রাক পণ্য রপ্তানি এবং আমদানি হয়েছে ৭৩২ ট্রাক পণ্য।
অক্টোবর মাসে আমদানি হয় ৬০১ ট্রাক পণ্য আর রপ্তানি হয় ৮৩৬ ট্রাক পণ্য। নভেম্বর মাসে ভারত থেকে আমদানি হয়েছে ৬৪৩ ট্রাক পণ্য এবং রপ্তানি হয়েছে ৯৭০ ট্রাক পণ্য। আমদানিকৃত পণ্যের মধ্যে ছিল শুটকি, চাল ও গম। আর রপ্তানিকৃত পণ্যের মধ্যে ছিল মাছ, রড, সিমেন্ট, ভোজ্য তেল, কয়লা, তুলা ও ফলমূলসহ বিভিন্ন পণ্য।
আমদানি ও রপ্তানি পণ্যবোঝাই প্রত্যেক ট্রাক থেকে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ প্রবেশ ফি, ওজন চার্জ, অবস্থান চার্জ ও পণ্যাগার চার্জসহ বেশকিছু চার্জ আদায় করে থাকে। এসব চার্জ বাবদ গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বন্দর কর্তৃপক্ষের আয় ছিল ২৯,৭১,৫৪১ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে আয় করেছে ৩ ৬,৫৭,৭২২ টাকা।
তবে রপ্তানির পাশাপাশি আমদানি বাড়ায় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে বন্দরের আয় আগের অর্থবছরের তুলনায় কয়েক গুণ বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। গত জুলাই মাস থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত আখাউড়া স্থলবন্দরের আয় হয়েছে প্রায় ৫৩ লাখ টাকা।
তবে আমদানি-রপ্তানি বাড়লেও পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর হিসেবে আত্মপ্রকাশের ১১ বছরেও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি আখাউড়া স্থলবন্দরে। ১৫ একর আয়তনের স্থলবন্দরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নেই কোনো আবাসন ব্যবস্থা। শ্রমিকদের জন্যও কোনো শেড তৈরি হয়নি। অথচ দেশের অন্য স্থলবন্দরগুলোতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে। পাশাপাশি শ্রমিকদের জন্যও শেড রয়েছে। এছাড়া বন্দরে শ্রমিকদের জন্য পর্যাপ্ত টয়লেটের ব্যবস্থাও নেই। শত শত শ্রমিকদের জন্য কেবল ছোট একটি টয়লেট ও গোসলখানা রয়েছে।
এছাড়া স্থলবন্দরে বিদ্যমান ওয়্যার হাউসটি চাহিদার তুলনায় ছোট। আমদানি-রপ্তানি বাড়ার কারণে আরও ১টি ওয়্যারহাউসের প্রয়োজন। এছড়া বিদ্যমান ইয়ার্ডটি সম্প্রসারণ এবং নতুন পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ওয়েব্রিজ স্কেল স্থাপন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বর্তমান সেমি ডিজিটাল ওয়েব্রিজ স্কেলটিতে মাঝেমধ্যেই ত্রুটি দেখা দেয়। ত্রুটি মেরামত করার আগ পর্যন্ত বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি কার্যক্রম ব্যাহত হয়।
বর্তমানে স্থলবন্দরে আছে কয়েক কক্ষ বিশিষ্ট ছোট অফিস, ১টি সেমি ডিজিটাল ওয়েব্রিজ স্কেল (১০০ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতা), ১টি ওয়্যার হাউজ (৮০০ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতা), ১টি ওপেন ইয়ার্ড ও ১টি ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ড এবং শ্রমিকদের জন্য ছোট্ট একটি টয়লেট ও গোসলখানা।
স্থলবন্দরে আরও যা যা প্রয়োজন তা হলো- ২টি পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ওয়েব্রিজ স্কেল, বিদ্যমান ওপেন ইয়ার্ড সম্প্রসারণ ও নতুন ১টি ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ড নির্মাণ এবং বন্দরের নিরাপত্তার জন্য সিসি ক্যামেরা স্থাপন। পাশাপাশি বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ডরমেটরি এবং শ্রমিকদের জন্য শেড ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট নির্মাণ করা প্রয়োজন।
ভারতীয় ট্রাক চালক রাজ্জাক মিয়া জানান, পণ্যবোঝাই ট্রাক নিয়ে আখাউড়া স্থলবন্দরে আসার পর বিভিন্ন কারণে কয়েকদিন সময় লাগে পণ্য খালাসে। কিন্তু স্থলবন্দরে শ্রমিকদের থাকার জন্য কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তাকে পণ্য খালাস না হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন ভারতে ফিরে যেতে হয়। এছাড়া শ্রমিকদের জন্য পর্যাপ্ত এবং স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের ব্যবস্থা নেই বলেও জানান তিনি।
স্থলবন্দরের কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেকে সময় বন্দর থেকে আমদানিকৃত পণ্য খালাসে বিলম্ব হয়। রপ্তানির জন্য পণ্যবোঝাই ট্রাক বন্দরে আসার পরও দুই-একদিন সময় লাগে রপ্তানি হতে। তখন নিরাপত্তার স্বার্থে ওয়্যার হাউসে পণ্য রাখতে হয়। সেজন্য বিদ্যমান ওয়্যারহাউসের পাশাপাশি আরেকটি ওয়্যার হাউস প্রয়োজন। এছাড়া আমদানি-রপ্তানি পণ্যবোঝাই ট্রাক রাখার জন্য বন্দরের ইয়ার্ডটিও সম্প্রসারণ জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ ইয়ার্ডে জায়গা না পেয়ে বন্দরের সামনের সড়কে ট্রাক রাখতে হয়। এতে করে পণ্যের নিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকি থাকে।
আখাউড়া স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'স্থলবন্দরের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইয়ার্ড সম্প্রসারণ এবং নতুন ওয়্যারহাউস করা জরুরি হয়ে পড়েছে। শ্রমিকদের জন্যও একটি শেড প্রয়োজন। এগুলোর ব্যাপারে আমরা বন্দর কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার বলেছি। তারা বন্দরের সার্বিক উন্নয়নে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে বলে আমাদের জানিয়েছে।'
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আখাউড়া স্থলবন্দরের সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'স্থলবন্দরের বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমরা চিঠির আদানপ্রদান করছি। বন্দরের সার্বিক উন্নয়নে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়ার কথা আমাদের জানানো হয়েছে। অচিরেই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।'