ই-কমার্স: এসক্রো সার্ভিসের মাধ্যমে রিফান্ডও এখন অনিশ্চিত
সর্বোচ্চ ১০ দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি না পেলে পেমেন্ট গেটওয়ে থেকে টাকা ফেরত পাবেন গ্রাহকরা- গত জুন মাসে এসক্রো সার্ভিস চালু করে ই-কমার্স গ্রাহকদের এমন আশ্বাস দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক।
এই আশ্বাসে ২১৪ কোটি টাকা অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করেও পণ্য না পাওয়া বিপুল সংখ্যক গ্রাহক এখনও তাদের পাওনা অর্থ ফেরত পাচ্ছে না। এসক্রো সার্ভিস চালুর আগে বিভিন্ন ই-কমার্স কোম্পানির প্রতারণার দায়ে গ্রাহকদের এসব পাওনা আটকে রয়েছে পেমেন্ট গেটওয়েগুলোতে। কবে নাগাদ এ অর্থ ফেরত দেওয়া যাবে, তাও বলতে পারছেন না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
এমনকি যেসব কোম্পানির নামে প্রতারণার মামলা নেই, সেসব কোম্পানির গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা দিলেও তা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, সারাদেশে কোন কোন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের নামে মামলা হয়েছে, আর কার নামে মামলা হয়নি, সে বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিংবা সরকারের অন্যান্য সংস্থাগুলোর কাছেই।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ই-কমার্স সেলের কর্মকর্তা ও উপসচিব মো. সাঈদ আলী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার উপায় বের করতে মঙ্গলবার সভা হবে। এর মধ্যে কোন উপায় বের করতে না পারলে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের কাছে এ বিষয়ে নির্দেশনা চাওয়া হবে। কোর্ট থেকে নির্দেশনা পাওয়া গেলে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।"
বিতর্কিত ই-কমার্স প্লাটফর্ম ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকাসহ প্রায় ৫০টি কোম্পানির বিরুদ্ধে গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে পণ্য সরবরাহ না করা, অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে গত জুন মাসে 'ডিজিটাল কমার্স নির্দেশিকা' জারি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, যেখানে অর্ডার করার ১০ দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
আর গত ৩০ জুন এসক্রো সার্ভিস চালু করে সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বলা হয়, গ্রাহকের পরিশোধ করা অগ্রিম মূল্য পেমেন্ট গেটওয়েগুলোতে জমা থাকবে। ই-কমার্স কোম্পানি পণ্য ডেলিভারি দেওয়ার প্রমাণ দাখিল করা সাপেক্ষে পেমেন্ট গেটওয়েগুলো ই-কমার্স কোম্পানিগুলোকে টাকা দেবে। পণ্য ডেলিভারি না করলে পেমেন্ট গেটওয়েগুলো ক্রেতাদের টাকা ফেরত দেবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, গত ৩০ জুন চালু করার পর থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত থার্ডপার্টি পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে ই-কমার্স গ্রাহকরা ৫০৫ কোটি টাকারও বেশি অর্থ প্রদান করেছেন। গেটওয়েগুলো সেলারদের কাছে প্রায় ২৯১ কোটি টাকা ছেড়েছে, তবে এখনও আটকে আছে ২১৪ কোটি টাকা।
এর মধ্যে পুলিশের অনুরোধে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিউকমের ১৬৬ কোটি টাকা ফ্রিজ করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আনলকের আদেশ জারি না করা পর্যন্ত কিউকমের গেটওয়ে ফস্টার টাকা ফেরত দিতে পারবে না।
ফস্টার ছাড়াও আরও ৪৮ কোটি টাকা আটকে আছে এসএসএল, সূর্যমুখী, বিকাশ, নগদ এবং সাউথইস্ট ব্যাংকে।
গত ২৫ অক্টোবর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে সঙ্গে নিয়ে এক বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এই ২১৪ কোটি টাকা দ্রুত ক্রেতাদের মাঝে ফেরত দেওয়ার ঘোষণা দেন। তার ওই ঘোষণার পরপরই ফস্টার গেটওয়ের কাছে জমা থাকা কিউকমের গ্রাহকদের ১৬৬ কোটি টাকা ডিফ্রিজ করার অনুরোধ জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককে গত অক্টোবরেই চিঠি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে এখনও তা ডিফ্রিজ করেনি। মঙ্গলবারের বৈঠকে ফস্টারকেও ডাকা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বাকি ৪৮ কোটি টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্ন তুলে ধরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সুনির্দিষ্ট মতামত চেয়ে ২৮ অক্টোবর চিঠি পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই চিঠিতে বলা হয়, মামলার কারণে যেসব কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা আটক হয়েছেন এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে, তারা গ্রাহকদের অর্ডার অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করেছে কি-না, তা যাচাই করার উপায় নেই।
চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলে, শুধু গ্রাহকের দাবি অনুযায়ী টাকা ফেরত দেওয়ার পর ভবিষ্যতে ই-কমার্স কোম্পানিগুলো পণ্য ডেলিভারি দেওয়ার তথ্য-প্রমাণ হাজির করে গেটওয়েগুলোর কাছে টাকা দাবি করলে, নতুন জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। তাই মামলা থাকা কোম্পানিগুলোর গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে কি-না, এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা চায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়ে নভেম্বরের প্রথম দিকে চিঠি পাঠায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এখনও এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের কোন মতামত পায়নি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এ প্রেক্ষিতে, যেসব ই-কমার্স কোম্পানির নামে মামলা নেই, শুধু সেসব কোম্পানির গ্রাহকদের আটকে থাকা টাকা ফেরত দিতে চলতি মাসের গোড়ার দিকে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এই বার্তা ফরোয়ার্ড করে গত সপ্তাহে পেমেন্ট গেটওয়েগুলোকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এবার দেখা দিয়েছে আরেক বিপত্তি! সারাদেশে হাজারো ই-কমার্স কোম্পানির মধ্যে কোনটির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, আর কার বিরুদ্ধে মামলা নেই- সে তথ্য জানা নেই পেমেন্ট গেটওয়েগুলোর। মামলা নেই, এমন ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর তালিকা চেয়ে তারা যোগাযোগ করছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে। বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করেও হালনাগাদ ও পূর্ণাঙ্গ কোন তালিকা পাচ্ছে না।
ফলে যেসব কোম্পানির নামে কোন মামলা নেই, পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে থাকা তাদের গ্রাহকদের টাকা ফেরত পাওয়াও এক ধরণের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।
পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে থাকা গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে না পারায় হতাশা রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যেও। তারা বলছেন, গ্রাহক স্বার্থ রক্ষার জন্য এসক্রো সার্ভিস চালু করা হলেও তা এখন গ্রাহকদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, যেসব ই-কমার্স কোম্পানির নামে প্রতারণা ও অর্থ পাচারের মামলা হয়েছে, এসব কোম্পানির অপরাধের দায়ে তাদের গ্রাহকদের অর্থ এভাবে আটকে রাখা কোনমতেই যৌক্তিক হচ্ছে না।
'এতে শুধু গ্রাহকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, সম্ভাবনাময় ই-কমার্স সেক্টরের প্রতি গ্রাহকদের বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোকে তা বুঝানো যাচ্ছে না,' যোগ করেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ তমাল টিবিএসকে বলেন, 'যেসব ই-কমার্স কোম্পানির নামে মামলা রয়েছে, প্রয়োজনে সেসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করে গ্রাহকদের পাওনা অর্থ ফেরত দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।'
তিনি বলেন, 'এসক্রো সার্ভিস এখনও ম্যানুয়ালি পরিচালিত হচ্ছে, এটাকে অটোমেটেড করা প্রয়োজন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ই-কমার্স কোম্পানিগুলো পণ্য ডেলিভারি করতে ব্যর্থ হলে গ্রাহক স্বয়ংক্রিয়ভাবে টাকা ফেরত পাবে- এমন ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য এসক্রো সার্ভিস পরিচালনায় একটি গাইডলাইন প্রণয়ন করা জরুরি।'