রাবারের দাম বাড়ায় বেড়েছে টায়ারের দামও
স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত রাবারের দাম বাড়ায় ফলে টায়ারের দাম অনেকটা বেড়ে ভোক্তাদের ওপর আর্থিক চাপ তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন শিল্পসংশ্লিষ্টরা।
গতকাল রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) প্রতি কেজি রাবার বিক্রি হয়েছে ৩২৬ টাকায়, যা মাত্র তিন মাস আগেও ছিল ১৬০-১৭০ টাকা। দেশের বৃহত্তম টায়ার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গাজী টায়ারসে সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ফলে বাজারের সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে। তবে উৎপাদনকারীরা বলছেন, রাবারের দাম বৃদ্ধির কারণে তারা উৎপাদন বাড়াতে পারছে না।
টায়ার উৎপাদনকারকরা বলছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফআইডিসি) রাবার রপ্তানি অব্যাহত রাখায় স্থানীয় টায়ার উৎপাদনকারীরা কাঁচামাল সংগ্রহ করতে হিমশিম খাচ্ছে।
তবে বিএফআইডিসির কর্মকর্তারা বলছেন, স্থানীয় উৎপাদনকারকদের চাহিদা না থাকলেই কেবল কর্পোরেশন রাবার রপ্তানি করে। তাদের সর্বশেষ শিপমেন্টও বুক হয়েছে কয়েক মাস আগে।
বাংলাদেশ টায়ার-টিউব ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং রূপসা টায়ারস অ্যান্ড কেমিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'টায়ার তৈরির অন্যতম কাঁচামাল কাঁচা রাবারের দাম দুই মাস আগেও ছিল প্রতি কেজি ১৬০-১৭০ টাকা। এখন সেই রাবারের দাম হয়েছে ৩২৬ টাকা। এছাড়া বেড়েছে ডলারের দাম ও ব্যাংকঋণের সুদহার। এসব কারণে টায়ার উৎপাদনের খরচ বেড়েছে।'
শফিকুর বলেন, প্রাকৃতিক রাবার রপ্তানিকারক প্রধান দুই দেশ ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে ঝড়ের পর একটানা বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে রাবারের দাম বেড়েছে।
তিনি বলেন, বিএফআইডিসি আন্তর্জাতিক মূল্য অনুসরণ করে। ফলে এই সুযোগে বিএফয়াইডিসি রাবারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এর আগে দাম ছিল ২৯৫ টাকা কেজি।
শফিকুর আরও বলেন, 'বিএফআইডিসি ভারতে রাবার রপ্তানি করেছে, কিন্তু এখন আমাদের উদ্যেক্তারা রাবার পাচ্ছে না। তাদের আমাদানি করতে হচ্ছে। অথচ ভারত ৬ লাখ টন রাবার উৎপাদন করেও সেগুলো তারা রপ্তানি করে না। আবার তারা ব্যবসায়ীদের সুযোগ দেয় কাঁচা রাবার আমাদনিতেও, সেখানে কোনো শুল্ক নেয় না।'
তিনি বলেন, বাংলাদেশে বছরে রাবার উৎপাদন হয় ১০ হাজার টন। দেশে রাবারের চাহিদা আছে প্রায় ১২-১৩ হাজার টন। সরকারের উচিত দেশি উদ্যোক্তাদের জন্য মানসম্পন্ন রাবার উৎপাদনে মনোযোগ দেওয়া।
টায়ারের দাম বেড়েছে ১৫%–২০%
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, গত দেড় মাসে খুচরা পর্যায়ে সব ধরনের টায়ারের দামই ১৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। গত ২৫ আগস্ট দুর্বৃত্তরা পুড়িয়ে দেয় গাজী টায়ারসের কারখানা। রিকশা, ভ্যান, সিএনজিসহ থ্রি-হুইলার, বাস, পিকআপের গাড়ির টায়ার তৈরি হতো গাজীর কারখানায়।
রিকশা ও ভ্যানের টায়ারের প্রায় ৫০ শতাংশই বিক্রি করত গাজী টায়ারস। এছাড়া বাস-পিকআপে অল্প পরিসরে টায়ার ব্যবহার করা হতো। এখন বাজারে তাদের পণ্য সরবরাহ বন্ধ থাকা এবং সেইসঙ্গে রাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় টায়ারের দাম বেড়েছে বলে জানান বিক্রেতারা।
গাজী টায়ারসের অ্যাকাউন্টস ও ফিন্যান্স বিভাগের নির্বাহী পরিচালক মো. ফখরুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, অগ্নিকাণ্ড ও লুটপাটের ঘটনায় তাদের সব মিলিয়ে ২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বর্তমানে দেশের বাজারে তাদের সব ধরনের টায়ার বিক্রি বন্ধ রয়েছে।
রাজধানীর বংশালের অটো পার্টস মার্কেটের হাবিব এন্টারপ্রাইজের মালিক মাহবুব উল্লাহ বলেন, 'আমরা দেশের বিভিন্ন টায়ার কোম্পানির ডিলার। এখন চাহিদা অনুযায়ী টায়ার পাচ্ছি না। প্রতিদিন পিকআপ গাড়ির টায়ারের আমাদের চাহিদা আছে ২০০টি, কিন্তু পাচ্ছি ২০টি। ইজিবাইকের টায়ারের দাম আকার ভেদে ৪০০-৫০০ টাকা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৯০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকায়। ব্যাটারিচালিত অটোর টায়ারের দাম ১ হাজার ৪৭০ টাকা।'
বংশালে তাহের অ্যান্ড ব্রাদার্স-এর বিক্রেতা মোহম্মদ মনির বলেন, গাজী টায়ার্স কারখানায় আগুন লাগার পর থেকে রিক্সার টায়ারে দাম বেড়েছে। যে টায়ারের দাম ছিল ৪৯০ টাকা, সেটি এখন ৬৫০ টাকা হয়েছে।
মনির জানান, গাজী টায়ারের দাম ছিল ৫৫০ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকায়। রূপসা টায়ারের দাম ছিল ৫৫০ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৯০ টাকায়।
বাংলামটরের আজাদ মোটরসের একজন বিক্রেতা বলেন, পিকআপ ট্রাকের টায়ারের দাম ৫০০-৭০০ টাকা বেড়েছে। মোটরসাইকেলের টায়ারের দামও ২০০-২৫০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গাজী টায়ার এখন আর বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না।
বিএফআইডিসির চেয়ারম্যান মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত কর্পোরেশনটি বছরে সাড়ে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টন রাবার উৎপাদন করে। 'তবে আমাদের দেশের চাহিদা অনেক, চাহিদা পূরণ করতে আমরা হাইব্রিড রাবার চারা লাগাব। আমরা উৎপাদন বাড়াতে কাজ করছি।'
দেশের প্রতিষ্ঠান থাকতে কেন রপ্তানি করা হয়—এমন প্রশ্নের জবাবে নাসির উদ্দিন বলেন, 'আমরা দেশের প্রতিষ্ঠানের কাছে আগে রাবার বিক্রি করি। দেশের প্রতিষ্ঠান যখন কেনে না, তখন আমরা চাহিদা পেলে বিদেশে রপ্তানি করি। সর্বশেষ ভারতে রাবার রপ্তানি করেছি।'
তিনি আরও বলেন, বিশ্ববাজারে প্রাকৃতিক রাবারের দাম বাড়ায় দেশের বাজারেও দাম বেড়েছে। 'আমরা আন্তর্জাতিক দাম অনুযায়ী রাবার বিক্রি করি।'
চলতি মাসে ভারতে ১০৫ টন রাবার বিক্রি
দেশি টায়ার উৎপাদক কোম্পানি মেঘনা ইনোভা রাবার কোম্পানি লিমিটেডের কমার্শিয়াল অফিসার এম এ মতিন টিবিএসকে বলেন, গত তিন মাস ধরে তাদের কোনো রাবার দেয়নি বিএফআইডিসি।
'তারা গত মাসেও ভারতে রপ্তানি করেছে। এভাবে চললে দেশের টায়ার শিল্প ধ্বংস হবে। এখন বাধ্য হয়ে আমাদের রাবার আমদানির দিকে যেতে হচ্ছে। রাবার সংকটে আমাদের টায়ার উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে,' বলেন তিনি।
মতিন আরও বলেন, 'আমরা বিএফআইডিসির কাছে প্রতি মাসেই রাবারের চাহিদা দিয়ে থাকি। সর্বশেষ আমরা গত বৃহস্পতিবার ২০০ টন রাবার চেয়েছি, তারা বলেছে আগামী মঙ্গলবার হয়তো ২০ টন রাবার দেবে।'
বিএফআইডিসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, মে মাসে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের অর্ডার থাকায় চলতি মাসে ভারতে ১০৫ টন রাবার রপ্তানি করেছে কর্পোরেশন।
তখন দেশি প্রতিষ্ঠানের চাহিদা না থাকায় রপ্তানি অর্ডার নেওয়া হয়েছিল,' বলেন তিনি।
বিএফয়াইডিসির ডেপুটি ম্যানেজার (রাবার) অজন্তা দেব টিবিএসকে বলেন, সম্প্রতি অতিবৃষ্টির কারণে দেশে রাবার সংগ্রহ ব্যাহত হয়েছে। এর ফলে চাহিদামতো দেশীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে রাবার বিক্রি করতে পারেনি কর্পোরেশন।
এখন রাবার সংকট রয়েছে বলে দেশের প্রতিষ্ঠানের চাহিদা থাকলেও আগস্ট মাস থেকে কোনো রাবার বিক্রি করতে পারেনি বলে জানান অজন্তা। চলতি সপ্তাহ থেকে তারা রাবার বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।