রপ্তানি তথ্যে গরমিল রোধে তিনটি নতুন কাস্টম প্রসিডিউর কোড সৃষ্টির সিদ্ধান্ত
একই পণ্য রপ্তানিতে একাধিকবার এন্ট্রি করার আশঙ্কা এড়িয়ে প্রকৃত রপ্তানির তথ্য বের করতে তিনটি নতুন কাস্টম প্রসিডিউর কোড সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার, যার মাধ্যমে পৃথকভাবে স্যাম্পল রপ্তানি, সিএমটি (কাট, মেইক ও ট্রিম) রপ্তানি ও স্থানীয় রপ্তানির হিসাব করা হবে।
এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংক বা সংশ্লিষ্ট লিয়েন ব্যাংকের পক্ষে যাতে বিদেশ থেকে রপ্তানির অর্থ দেশে আনা মনিটরিং করা সহজ হয়, সেজন্য বিল অভ এক্সপোর্টের ক্ষেত্রে এক্সপোর্ট নাম্বারকে বাধ্যতামূলক ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা হবে। অর্থাৎ বিল অভ এক্সপোর্টের ক্ষেত্রে এক্সপোর্ট নাম্বার না দিলে তা অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে এন্ট্রি হবে না।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, অনেক ক্ষেত্রে অ্যাসেসড-ডিউটি পরিশোধিত বিল অভ এক্সপোর্টের পণ্য বিভিন্ন কারণে জাহাজীকরণ বা প্রকৃত রপ্তানি হয় না। ফলে শুধু যেসব পণ্য জাহাজীকরণ (অন বোর্ড) করা হয়, সেসব রপ্তানি চালানের ভিত্তিতে রপ্তানির তথ্য প্রস্তুত করবে সরকার। এজন্য এক্সপোর্ট জেনারেল ম্যানিফেস্ট অটোমেটেড বা অনলাইনে করতে হবে।
সম্প্রতি 'অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড ডেটাবেইজ-এ আমদানি-রপ্তানি ডাকা সংকলন, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ' বিষয়ক এক কর্মশালায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
অর্থ মন্ত্রণালয় আয়োজিত ওই কর্মশালায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
শাশা ডেনিমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ টিবিএসকে বলেন, রপ্তানির প্রকৃত তথ্য নিশ্চিত করতে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেগুলো খুবই যৌক্তিক।
'পৃথক কাস্টমস প্রসিডিউর কোড করলে বিভিন্ন খাতে রপ্তানির চিত্র যেমন পাওয়া যাবে, তেমনি বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে ভ্যালু এডিশনের (মূল্য সংযোজন) চিত্রও পাওয়া যাবে। এতে ভবিষ্যতে জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়া সহজ হবে এবং সরকারের পক্ষে খাতভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়াও সহজ হবে,' বলেন তিনি।
শামস মাহমুদ আরও বলেন, 'বিল অভ এক্সপোর্টের ক্ষেত্রে এক্সপোর্ট নম্বর বাধ্যতামুলক করার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা গেলে খুবই ভালো হবে। এতে রপ্তানি আয় বাংলাদেশে আনা সহজ হবে এবং রপ্তানিকারকদের স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।'
চলতি বছরের জুলাইয়ে দেশের রপ্তানি আয়ে বড় ধরনের গরমিল ধরা পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা যায়, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত রপ্তানি আয় হয়েছে ৪০.৭৩ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ইপিবির হিসাবে একই সময়ে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৫১.৫৪ বিলিয়ন ডলার।
অর্থাৎ সরকারের দুই সংস্থার মধ্যে হিসাবের ব্যবধান ১০.৮১ বিলিয়ন ডলার। এতে সরকারের আর্থিক হিসাব ঘাটতি হয়নি, তবে চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দেয়। বিষয়টি নিয়ে তখন ব্যাপক তোলপাড় শুরু হলে তিন মাসের মধ্যে রপ্তানির প্রকৃত তথ্য প্রকাশের উপায় নির্ধারণ করতে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এরপর থেকে মাসিক রপ্তানির তথ্য প্রকাশ বন্ধ রেখেছে ইপিবি।
অবশ্য চলতি মাসে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো 'বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যাবলী সম্পর্কিত বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রতিবেদন (২০২৩-২০২৪ অর্থবছর)'-এ বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত রপ্তানির পরিমাণ ৪৪.৪৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ একই সময়ে ইপিবির দেখানো রপ্তানি আয়ের তুলনায় এটি ৭.১০ বিলিয়ন ডলার কম।
গত ১৫ জুলাই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় রপ্তানি তথ্যের এই বড় ফারাকের প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক, ইপিবি ও এনবিআরকে তিন মাস সময় দেওয়া হয়। ততদিন পর্যন্ত রপ্তানি আয়ের মাসিক তথ্য প্রকাশ না করতে ইপিবিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
অর্থ বিভাগ আয়োজিত কর্মশালার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, কাস্টমস হাউজের তথ্যে একই রপ্তানি একাধিকবার দেখানো (ডাবল বা ট্রিপল কাউন্টিং) এবং পণ্যের গুণগত মান বা অন্য কারণে কাস্টমস হাউজের শিপমেন্ট বাতিলের পর আবারও রপ্তানির ঘটনাকে প্রাথমিকভাবে রপ্তানি তথ্যে গরমিলের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
রপ্তানির সঠিক তথ্য বের করতে ছয়টি সিদ্ধান্ত হয়েছে কর্মশালায়। এর মধ্যে রয়েছে রপ্তানির প্রকৃত তথ্য হিসাব করতে এনবিআর তিনটি পৃথক কাস্টমস প্রসিডিউর কোড সৃষ্টি করবে। এর একটিতে শুধু স্যাম্পল রপ্তানির তথ্য থাকবে
যেসব পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান সব ধরনের কাঁচামাল সরবরাহ করে এবং রপ্তানিকারক শুধু পণ্য সেলাই করা বা প্রস্তুত করার মজুরি পান, সেসব পণ্য রপ্তানির হিসাব রাখতে আলাদা একটি কাস্টমস প্রসিডিউর কোড সৃষ্টি করা হবে।
এছাড়া, স্থানীয় রপ্তানি বা এক ইপিজেড (রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল) থেকে অন্য ইপিজেডে বা বাংলাদেশের ভেতরে রপ্তানির হিসাব রাখার জন্য আরেকটি কাস্টমস প্রসিডিউর কোড সৃষ্টি করা হবে।
ওয়ার্কশপের কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে, 'এতে মোট রপ্তানির মধ্যে ক্যাটাগরিভিত্তিক রপ্তানির পরিমাণ, মূল্যসহ অন্যান্য তথ্য পাওয়া সহজ হবে এবং রপ্তানি আয়ের তথ্যও সঠিক হবে।'
এতে আরও বলা হয়েছে, প্রকৃত রপ্তানির তথ্যের জন্য বিল অভ এক্সপোর্টের ক্ষেত্রে এক্সপোর্ট নাম্বারকে বাধ্যতামূলক ক্ষেত্র (ম্যান্ডেটরি ফিল্ড) হিসেবে বিবেচনা করা হবে। অর্থাৎ বিল অভ এক্সপোর্টের ক্ষেত্রে এক্সপোর্ট না দিলে তা অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে এন্ট্রি হবে না। এটি নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশ ব্যাংক বা সংশ্লিষ্ট লিয়েন ব্যাংকের পক্ষে বিদেশ থেকে রপ্তানির অর্থ দেশে প্রত্যাবাসন মনিটরিং করা সহজ হবে।
দেশের বিভিন্ন আইন ও উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে রপ্তানির সংজ্ঞা এবং ব্যাখ্যা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। তাই রপ্তানির একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে কর্মশালায়।
রপ্তানির তথ্যে ভুল বা গরমিল হওয়ার আশঙ্কা কমাতে আগামী এক বছর মাসিক রপ্তানির তথ্য প্রকাশের আগে তা যাচাই-বাছাই করার জন্য একটি সেল বা কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
সম্প্রতি ইপিবির সঙ্গে বৈঠক শেষে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, প্রকৃত রপ্তানির তথ্য শিগগিরই সমন্বয় করা হবে। ইপিবি ও এনবিআরের তথ্যের গরমিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, দূর করা হবে। ইপিবিকে একটি প্রক্রিয়াও তৈরি করতে বলেছেন তিনি।
আনুষ্ঠানিকভাবে জুন পর্যন্ত রপ্তানি তথ্য প্রকাশ না করলেও গত অর্থবছরে মোট ৫১.০৭ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির তথ্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে ইপিবি। এর মধ্যে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৪৪.৪৮ বিলিয়ন ডলার ও সেবা রপ্তানি হয়েছে ৬.৬০ বিলিয়ন ডলার।
চলতি অর্থবছরে পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ৫০ বিলিয়ন ডলার ও সেবা রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ৭ বিলিয়ন ডলার প্রাক্কলন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।