যেভাবে রউফ তালুকদারের রেখে যাওয়া রিজার্ভ-জট ছাড়াচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
বাংলাদেশের আন্তঃব্যাংক ফরেক্স মার্কেটে এখন গড়ে ৫০ মিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত থাকছে। ব্যাংকগুলো তাদের ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে চাচ্ছে, ব্যবসার আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে ডলার লাগবে কি না। এমন পরিবর্তন বহু মাস ধরে দেখা যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের নির্দেশনায় ব্যাংকগুলো বকেয়া পরিশোধ করছে, যার ফলে বাজারের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। স্থানীয় ব্যাংকগুলোর ওপর বিদেশি ব্যাংকগুলোর আরোপিত বৈদেশিক মুদ্রা বাণিজ্য ক্রেডিট সীমা হ্রাস সত্ত্বেও এ অগ্রগতি হয়েছে।
উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তা ঋণ চাওয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে ব্যাংকাররা আশাবাদী। তারা বিশ্বাস করেন, এটি বৈদেশিক মুদ্রার বাজারের তারল্য এবং স্থিতিশীলতাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। কিন্তু নতুন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এক মাসে কী করেছেন যা তার পূর্বসূরি গত দুবছরে করতে পারেননি?
প্রথমত, বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা কমে গেছে। দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নজরদারির কারণে বাণিজ্য-ভিত্তিক অর্থপাচার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই নতুন গভর্নর ক্রলিং পেগ এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেমের অধীনে ১১৭ টাকার মিড রেটে ২.৫ শতাংশ ব্যান্ড চালু করেন, যার ফলে ব্যাংকগুলো ডলার লেনদেনের জন্য সর্বোচ্চ ১২০ টাকা পর্যন্ত চার্জ করতে পারে।
এ পদক্ষেপ এবং ব্যাংকগুলোকে দেওয়া আশ্বাসের ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। বিদেশি ব্যাংকগুলোও স্থানীয় ব্যাংকগুলোতে ক্রেডিট লাইন বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভরসা পেয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি ন্যূনতম পর্যায়ে কমিয়ে এনেছে এবং সরকারি সংস্থাগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাহায্য না নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারি এলসির (ঋণপত্র) জন্য ডলারের ব্যবস্থা করতে বলেছে।
এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে নেওয়া এসব উদ্যোগ দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় দৃশ্যমান পরিবর্তন এনেছে, যার ফলে দ্রুত স্বস্তি আসার পাশাপাশি সামনের দিনগুলোতে আরও স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে।
যেসব কারণে দ্রুত কমেছিল রিজার্ভ
২০২১ সালের আগস্টে রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যাওয়া দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনর্গঠন করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন অভিভাবকের জন্য সত্যিই একটি কঠিন কাজ। গত কয়েক দশকের রিজার্ভের ধারাবাহিক উত্থানের ফলে বিগত সরকারের নীতিনির্ধারকেরা রিজার্ভকে এমনভাবে ব্যবহার করেছিলেন, যা সমালোচকদের মতে অবিবেচনাপ্রসূত ছিল।
এর একটি উদাহরণ পাওয়া যায় ২০১৪ সালের দিকে, যখন দুর্নীতির অভিযোগের কারণে বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য বৈশ্বিক ঋণদাতারা পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে আসে। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা তহবিলের প্রস্তাব করেছিল, যা শেখ হাসিনার সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে সেতু প্রকল্পটি এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তে বড় প্রভাব রেখেছিল। অর্থনীতিবিদেরা তখন সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক রিজার্ভ ব্যবহার করা হবে অপরিণামদর্শী, এবং এর ফলে দেশের বাহ্যিক বাণিজ্য লেনদেন ও ঋণ পরিষেবা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।
তবে এ উদ্বেগ উপেক্ষা করা হয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য পর্যায়ক্রমে এবং প্রয়োজনে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহের দায়িত্ব নেয়। ৩.৫৬ বিলিয়ন ডলার প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে ব্যাংকটিকে বিদেশি ক্রয়ের বিল পরিশোধের জন্য ২.৪ বিলিয়ন ডলার দিতে হয়েছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা যেকোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ভল্ট থেকে প্রচুর পরিমাণে নগদ ডলার ব্যয় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। অন্যদিকে অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য প্রাপ্ত সফট লোনের ক্ষেত্রে ঋণদাতারা সাধারণত গ্রেস পিরিয়ড এবং ঋণ পরিশোধের দীর্ঘ সময় দেওয়ায় এমন ঝুঁকি থাকে না।
২০২১ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল (বিআইডিএফ) গঠন করা হয়। 'বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বড় সঞ্চয়'-এর ওপর ভিত্তি করে নেওয়া এ সিদ্ধান্তের পেছনে ধারণা ছিল যে, উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ডলার সরবরাহে রিজার্ভ ব্যবহার করা যেতে পারে।
পায়রা বন্দরের রামনাবাদ চ্যানেলের অর্থায়নের মাধ্যমে তহবিলটির যাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সে তহবিলে এটির 'উদ্বৃত্ত' বৈদেশিক রিজার্ভ ব্যবহার করবে বলে সম্মত হয়, যা সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে পায়রা বন্দরে ঋণ প্রদান করবে। সে সময়ে আব্দুর রউফ তালুকদার ছিলেন অর্থ বিভাগের সচিব।
কোভিড-১৯ মহামারি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার পর ততদিনে এক বছর পেরিয়ে গেছে। আমদানি দায় ব্যাপকভাবে কমে আসা, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি এবং রপ্তানি যতটা আশঙ্কা করা হয়েছিল ততটা না কমায় ২০২১ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায় (বিপিএম৬ অনুসারে রিজার্ভ ছিল ৩৬ বিলিয়ন ডলার)। সে বছর আগস্টে রিজার্ভ আরও বৃদ্ধি পেয়ে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায় (বিপিএম৬ অনুসারে ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলার)।
তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন আব্দুর রউফ তালুকদার। কোভিডের ক্ষতি থেকে পুনরুদ্ধারে লড়াইরত অর্থনীতি ক্রমবর্ধমান আমদানি চাপ মোকাবিলা করছিল। তার নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে উদারচিত্তে ডলার বিক্রি শুরু করে। এদিকে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি মূল্য অস্থিরতা এবং উচ্চ ফ্রেইট চার্জের জন্যও এ যুদ্ধ দায়ী ছিল।
এ সময় দেশ থেকে পুঁজির বিশাল অংশ বেরিয়ে যায়। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আকস্মিক পতনের পর থেকে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সবাই এখন খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে কীভাবে রাঘব বোয়ালেরা দেশের ব্যাংকগুলোকে ফাঁকা করে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ডলার দেশের বাইরে পাচার করেছে।
দেশের সবচেয়ে খারাপ ও দীর্ঘতম সময়ের বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের অস্থিরতাকালে শীর্ষপদে ছিলেন রউফ তালুকদার। ২০২১ সালের শেষের দিকে ৮৬ টাকার নিচে থাকা মার্কিন ডলার বর্তমানে ১২০ টাকায় স্থিতিশীল হওয়ার আগে দ্রুত ধারাবাহিকভাবে ১১৮ টাকায় উঠে যায়। ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের দামে ছিল বিশাল পার্থক্য।
আমদানি প্রায় দুই বছর ধরে সীমিত ছিল, কিন্তু রিজার্ভ দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানির বৃদ্ধি সত্ত্বেও তিন বছর আগের রিজার্ভের অর্ধেকে নেমে আসা রিজার্ভের এ দ্রুত পতন ঠেকানো যায়নি।
ব্যাংক ও খোলাবাজারের ডলারের দামের বিশাল ব্যবধান — কখনও কখনও প্রতি ডলারে ৮-১০ টাকার পার্থক্য — অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে আরও বেশি রেমিট্যান্স আকর্ষণ করে। বিদেশে যাওয়া অভিবাসী শ্রমিকদের সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি সত্ত্বেও এটি রিজার্ভ হ্রাসের একটি প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
২০২১ সালের আগস্ট থেকে মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার কমে এ বছরের আগস্টে ২৫.৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। বিপিএম৬ অনুসারে এটির পরিমাণ ২০.৫ বিলিয়ন ডলার, যেখানে নেট ব্যবহারযোগ্য পরিমাণ আরও কম।
এখন কাজ কঠিন
২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবকাঠামো তহবিলের জন্য রিজার্ভ ব্যবহারের সময় অর্থনীতিবিদরা যে সতর্কতা দিয়েছিলেন, তা এখন সত্য প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে ডলারের দাম বেশি। জ্বালানি আমদানির অপরিশোধিত বিল ক্রমাগত বাড়ছে। এর ফলে অন্তর্বর্তী সরকার উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে মরিয়া হয়ে বাজেট সহায়তা খুঁজছে।
বিগত সরকার আইএমএফের সঙ্গে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্যাকেজের আলোচনা শুরু করলেও, নতুন অন্তর্বর্তী সরকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল করতে এবং বৈদেশিক বকেয়া পরিশোধের মাধ্যমে অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে ৪টি আন্তর্জাতিক ঋণদাতার কাছ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তা চেয়েছে।
ফরেক্স মার্কেট এখন স্থিতিশীল বলে মনে হচ্ছে। খোলাবাজারও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে আরও বেশি রেমিট্যান্স আনতে হলে ব্যাংকগুলোকে আরেকটু কাঠখড় পোড়াতে হবে। তাদের পরিষেবার মান উন্নত করতে হবে এবং বিদেশ থেকে লেনদেনের জন্য খরচ ও সময় কমাতে হবে, যাতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাতে এবং ডলার বন্ড ও অফশোর অ্যাকাউন্টে জমা রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
বর্তমানে ডলারের হার প্রবাসী আয় পাঠানোর জন্য যথেষ্ট অনুকূল। পাশাপাশি, রেমিট্যান্সের ২.৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনার বিষয়ে পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে, কারণ এটি সরকারি কোষাগারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
যদি কোনো ফাঁকফোকর থেকে থাকে, তবে অন্তর্বর্তী সরকারকে সেগুলো দূর করতে হবে, যাতে অর্থ পাচারকারীদের জন্য হুন্ডি চ্যানেল আরও কঠিন হয়। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল, অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল ইত্যাদির মাধ্যমে রিজার্ভের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয় রোধ করে তা নিরাপদ স্তরে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব এখন অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর।