বিদেশি ঋণের প্রবাহ থেকে জুনে উদ্বৃত্ত বেড়েছে ২.৫ বিলিয়ন ডলার
২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক বেশকিছু ঋণ পাওয়ায় দেশের আর্থিক হিসাবের উদ্বৃত্ত প্রায় ২.৫ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে আর্থিক হিসাব উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ৪.৫৫ বিলিয়ন ডলার, যেটি মে মাস শেষে ২ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি ছিল। অবশ্য ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় এ উদ্বৃত্তের পরিমাণ কিছুটা কমেছে। ঐ অর্থবছর শেষে আর্থিক হিসাবের উদ্বৃত্ত ছিল ৭ বিলিয়ন ডলার।
আর্থিক হিসাবের ভারসাম্য একটি দেশের বৈদেশিক পেমেন্টের প্রধান উৎস। যখন কোনো দেশের বর্তমান হিসাব নেতিবাচক হয়ে যায়, তখন আর্থিক হিসাব থেকে বিদেশি পেমেন্ট করা হয়। আর যদি আর্থিক হিসাবও নেতিবাচক হয়ে যায়, তাহলে সরাসরি রিজার্ভ থেকে পেমেন্ট করা হয় ।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের পেমেন্টের ভারসাম্যে (ব্যালেন্স অব পেমেন্টস) বাণিজ্য ঘাটতি আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার বিলিয়ন কমেছে। একই সঙ্গে ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় বর্তমান হিসাব ঘাটতিও প্রায় একই পরিমাণ কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আর্থিক হিসাবের ক্ষেত্রে মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেড়ে যাওয়াই মূলত উদ্বৃত্ত অর্থের পরিমাণ বাড়িয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ এসেছে ৯.৬৮ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১১ শতাংশ বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মতে, কয়েকবছর আগেও দেশে বৈদেশিক ঋণের প্রবাহ আরোও ভালো ছিল; কিন্তু স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেয়ার প্রবণতা কমে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের সুদ হার বৃদ্ধি, বিনিময় হারের ঝুঁকিসহ নানা কারণে ঋণ গ্রহণের আগ্রহ কমে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের সুদের হার বেড়ে যাওয়া, এক্সচেঞ্জ রেট রিস্কসহ নানা কারণে লোন নেওয়ার প্রতি গ্রাহকদের আগ্রহ কমে গেছে।
তিনি বলেন, "নতুন ঋণ নেওয়ার তুলনায় ঋণ পরিশোধে গ্রাহকেরা বেশি আগ্রহী। আমদানি কমে যাওয়াও ঋণ কমে যাওয়ার একটা কারণ।"
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "জুন মাসে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক ঋণ, বিশেষ করে বাজেট সহায়তা ঋণ পাওয়ায় আর্থিক হিসাবের উদ্বৃত্ত বেড়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, এসব ঋণ ভবিষ্যতে পরিশোধের বাধ্যবাধকতা তৈরি করছে।"
বাণিজ্য ঘাটতি ১৮% কমেছে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। ফলে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি না থাকা সত্ত্বেও ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি ১৮ শতাংশ কমে গিয়ে ২২.৪৩ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।
একটি দেশের রপ্তানি ও আমদানি পরিমাণের পার্থক্যই হলো ট্রেড ব্যালেন্স।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় হয়েছে ৬৩.২৪ বিলিয়ন ডলার এবং রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৪০.৮১ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় আমদানি ও রপ্তানি দুটোই কমেছে সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরেকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার কারণে ইমপোর্ট পেমেন্ট ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কমেছে। এছাড়া পুরো বছরজুড়েই ব্যাংকগুলো ডলার সংকটে ভুগেছে। ফলে ব্যবসায়ীরা চাহিদামতো আমদানি এলসি খুলতে পারেনি।
তবে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকেও আমদানি এলসি খোলার চাহিদা কিছুটা কমেছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
চলতি হিসাব ঘাটতি সংকুচিত হয়েছে
২০২৩-২৪ অর্থবছরে রেমিট্যান্স আগের অর্থবছরের তুলনায় ২ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি কমার সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান হিসাব ঘাটতিও প্রায় ৪৪ শতাংশ কমে ৬.৫১ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।
চলতি হিসাব, যেটিতে বাণিজ্য ব্যালেন্স (পণ্য রপ্তানি থেকে আমদানি বাদ), বিদেশ থেকে গড় আয় এবং গড় বর্তমান স্থানান্তর অন্তর্ভুক্ত– সেটি বৈদেশিক পেমেন্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, "চলতি হিসাব ঘাটতি কমে যাওয়ার একটা অর্থ হলো আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টের পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি করেছে। তবে আমরা এখনো স্বস্তির জায়গায় আসিনি।"
তিনি আরও বলেন, "একটা সময় আমাদের চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত ছিল। ঐ জায়গায় পৌঁছানোর আগে আমদানি খুব বেশি বাড়তে দেওয়া উচিত হবে না।"
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে অগ্রহণযোগ্য ব্যালেন্স বা "এরর অ্যান্ড অমিশন" ২.৮৯ বিলিয়ন ডলার দাঁড়িয়েছে। এটি আগের অর্থবছরের তুলনায় ১ বিলিয়ন ডলার কম।
এ বিষয়ে অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, "এরর অ্যান্ড অমিশন কয়েক বছর আগেও এত বেশি ছিল না। সংখ্যাটা এত বড় কেন হচ্ছে বা এর পেছনে কোনো যুক্তিসংগত কারণ আছে কিনা তা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।"
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে মোট বৈদেশিক পেমেন্ট ঘাটতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৪৮ শতাংশ কমে ৪.৩ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। সাধারণত এই ঘাটতি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে পরিশোধ করা হয়। ফলে বিপিএম৬ নির্দেশনা অনুযায়ী, গত বছরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে ৩ বিলিয়নের ডলারের বেশি।
সিপিডি-র এই বিশিষ্ট ফেলো জানিয়েছেন, রিজার্ভের উপর চাপ কিছুটা কমলেও তা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
তিনি রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য হুন্ডি বন্ধ করা এবং পণ্য ও পরিষেবার রপ্তানি বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
অধ্যাপক মুস্তাফিজ বলেন, "স্বল্পমেয়াদে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পণ্যের পরিবহণ স্বাভাবিক রাখা গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসায়িক উৎপাদনশীলতা বাড়ানো এবং ব্যবসার খরচ কমানোর চেষ্টা করা উচিত।"
তিনি উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া দ্রুত করার এবং পাইপলাইনে থাকা বৈদেশিক ঋণ ছাড় করার গুরুত্বও উল্লেখ করেছেন, যা রিজার্ভ বাড়াতে এবং মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করবে।