ইন্টারনেটের গতি, চালানে দেরি ও বন্দরজট নিয়ে উদ্বেগ পোশাক খাতের ক্রেতাদের
আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড, বায়ার ও খুচরা বিক্রেতারা বাংলাদেশি সাপ্লায়ারদের সঙ্গে বৈঠকে ৩টি বিষয়ে প্রাথমিক উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছেন — ধীরগতির ইন্টারনেট, সময়মতো পোশাকের চালান পৌঁছানো ও চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনারজট।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে উদ্ভূত সমস্যা নিয়ে মতামত সংগ্রহের জন্য সোমবার (২৯ জুলাই) ঢাকার উত্তরা কার্যালয়ে এক বৈঠকের আয়োজন করে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষ শুরু হলে জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহের পর থেকে দেশে ইন্টারনেট পরিষেবা সাময়িকভাবে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রাখা হয়, মোবাইল ডেটা ১০ দিন পরে চালু করা হয় এবং চট্টগ্রাম বন্দর অন্তত পাঁচ দিনের জন্য প্রায় সম্পূর্ণ অচল থাকে।
ক্রেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ইন্টারনেট চালু হলেও গতি এখনও স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি। স্থবির গতির কারণে তারা অর্ডার নিশ্চিতকরণের নথিপত্র সংযুক্ত করতে, চালান ও বিল পরিশোধের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে পারছেন না।
যদিও বায়ার ও ব্র্যান্ডের প্রতিনিধিরা বৈঠক নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেননি, টিবিএস অন্তত চারজন ক্রেতার সঙ্গে কথা বলেছে যারা নিশ্চিত করেছেন, তারা অর্ডার বাতিল বা ছাড় দাবি করবেন না। পরিস্থিতি সরবরাহকারীদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলে স্বীকার করছেন তারা।
ক্রেতারা পোশাক পণ্যের সময়মতো চালান নিশ্চিত করতে এবং রপ্তানিকারকদেরকে মূল কার্যালয়ের সঙ্গে নির্বিঘ্ন যোগাযোগের সুবিধার্থে উচ্চগতির, নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট ও ব্রডব্যান্ড পরিষেবা চালু করতে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ চালিয়ে নিতে আহ্বান জানিয়েছেন।
একটি শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডের একজন কান্ট্রি ম্যানেজার নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, ইন্টারনেট বিভ্রাটের কারণে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য দেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের সময় ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট সম্পর্কে সরকারের ব্যাখ্যা নিয়ে বিশ্বব্যাপী কর্মকর্তারা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
বায়ারদের ফোরামে ৫০টির বেশি সদস্য থাকা সত্ত্বেও কেবল এইচঅ্যান্ডএম, এমঅ্যান্ডএস ও বেস্টসেলার-এর তিনজন ব্র্যান্ড প্রতিনিধি ফোরামের মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, উত্তরায় বিক্ষোভের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবর শোনার পর বৈঠকে যোগ দেননি অনেক সদস্য।
ব্যবসার পরিস্থিতি
একটি বায়িং হাউজের বিজনেস ডেভেলপমেন্টের প্রধান টিবিএসকে বলেন, তাদের একজন ভারতীয় ক্রেতার সঙ্গে ২৫ মিলিয়ন ডলারের ব্যবসায়িক চুক্তি রয়েছে। তারা ১২–১৩ জুলাই বেনাপোল স্থলবন্দরের মাধ্যমে পণ্য পাঠিয়েছেন।
'এখন ধীরগতির ইন্টারনেটের কারণে আমরা নথি পাঠাতে পারছি না,' জানিয়ে তিনি বলেন, ইন্টারনেটের কম গতির কারণে আরও অনেক রপ্তানিকারক একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।
এদিকে একজন শীর্ষস্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারক জানান, তিনি আগামী সপ্তাহে দুটি বড় মার্কিন ব্র্যান্ডের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করার পরিকল্পনা করেছেন, কারণ তাদের দিক থেকে আগামী গ্রীষ্মের মৌসুমে আরও অর্ডার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
'তবে এখন তারা এসব অর্ডার নিয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য করছেন না, কারণ তারা সরবরাহ চেইনের আরও বিভ্রাটের বিষয়ে উদ্বিগ্ন,' বলেন তিনি।
এ উদ্যোক্তা আশা করছেন, তিনি মার্কিন ক্রেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বললে তাদেরকে বোঝাতে সক্ষম হবেন।
'দেশের ভাবমূর্তি নিয়ে এখনো প্রশ্ন ওঠেনি'
বৈঠকের পর বিজিএমইএ সভাপতি এসএম মান্নান কচি বলেন, ক্রেতারা তাদের ইন্টারনেটের মান বাড়াতে এবং নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের আহ্বান জানিয়েছেন।
ক্রেতারা বিক্ষোভের সময় ইন্টারনেট বিভ্রাটের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, এতে বিশ্বব্যাপী অফিসগুলোর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ব্যাহত হয়েছিল।
তবে কচি আরও বলেন, ক্রেতারা ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেশের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। তারা ভবিষ্যতে সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে আগ্রহী।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো আশ্বস্ত করেছে, তারা সাম্প্রতিক সহিংসতা ও উৎপাদন বন্ধের কারণে ডিসকাউন্ট, এয়ার শিপমেন্ট বা কার্যাদেশ বাতিলের অনুরোধ করবে না।
এইচএন্ডএম আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক জিয়াউর রহমান টিবিএসকে বলেন, শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের ফলে শিপমেন্ট বিলম্বের জন্য কোম্পানি কোনো ছাড় চাইবে না বা অর্ডার বাতিল করবে না, কারণ উদ্ভূত পরিস্থিতি রপ্তানিকারকদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, এ ব্যাঘাতের কারণে প্রায় সাত হাজার ৪০০ কোটি টাকা উৎপাদন ক্ষতি, ১১ হাজার ৫০ কোটি টাকা মজুরি ক্ষতি এবং তিন হাজার কোটি টাকা ডাইং, ফিনিশিং ও ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের ক্ষতি হয়েছে।
বিজিএমইএ-এর তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশ প্রতিদিন গড়ে ১৬ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে। ১৮ জুলাই রাত থেকে শুরু হওয়া ইন্টারনেট ব্যাঘাতে পোশাক খাতের ৭৪০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে। ব্ল্যাকআউটের কারণে পরদিন থেকে রপ্তানি বন্ধ ছিল।
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সহিংসতায় প্রায় ১৫০ জন নিহত হয়েছেন। তবে গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, শিক্ষার্থী ও শিশুসহ প্রকৃত মৃতের সংখ্যা কমপক্ষে ২০০ হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এক বছরের আগের একই সময়ের তুলনায় ২০২৩–২৪ অর্থবছরের জুলাই–মে সময়ে দেশের পোশাকের চালান ৫ দশমিক ২ শতাংশ কমে ৩৩.০৪ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।