ব্যাংক খোলার পর কমে এসেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ ও আমদানি
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে অস্থিরতা, ৫ দিনের ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট এবং তিন দিন ব্যাংক বন্ধ থাকার কারণে গত সপ্তাহে রেমিট্যান্স প্রবাহ ও আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৯-২৪ জুলাই পর্যন্ত ৬ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ৭৮ মিলিয়ন ডলার। ব্যাংকিং চ্যানেলে সাধারণত একদিনেই এই পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা। সে হিসাবে জুলাই মাসের প্রথম ২৪ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ১.৫ বিলিয়ন ডলার।
এর আগে ডলারের দর বাড়ানোর পর গত মে মাসে ২.২৫ বিলিয়ন ডলার ও জুনে ২.৫৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে। পরপর ওই দুই মাসের রেমিট্যান্স ছিল একক মাস হিসাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বোচ্চ।
ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংক খোলার পর রেমিট্যান্স আসার গতি খুব বেশি বাড়েনি। ঈদ-পরবর্তী মাস হিসেবে জুলাইয়ে এমনিতেই রেমিট্যান্স কিছুটা কম আসে। তবে বর্তমানে যে গতিতে রেমিট্যান্স আসছে, এটা অস্বাভাবিক। এমন গতি বজায় থাকলে জুলাইয়ে রেমিট্যান্স আয় ২ বিলিয়ন ডলারের নিচে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি হুন্ডিতে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা বাড়ছে প্রবাসীদের মধ্যে।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন খাতে কাজ করা শ্রমিক জমায়েতের বেশ কয়েকটি ভিডিও ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়েছে। এসব ভিডিওতে শ্রমিকদের বৈধ পথে রেমিট্যান্স না পাঠাতে বলা হয়েছে। দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে চলমান অস্থিরতার প্রতিবাদে এমন পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে ভিডিওতে। এছাড়া ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের কারণে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারার একটা ক্ষোভ কাজ করছে প্রবাসীদের মধ্যে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষে একজন প্রতিমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতার পক্ষ থেকে প্রবাসীদের বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর অনুরোধের ভিডিও ঘুরছে ইন্টারনেটে।
এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো রেমিট্যান্সের ডলার কম পাচ্ছে উল্লেখ করে একটি বেসরকারি ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতে আমরা রেমিট্যান্সের অগ্রিম অর্ডার দিয়ে এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোকে প্রি-ফান্ড করে থাকি। ব্যাংক খোলার পর গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকটি এক্সচেঞ্জ হাউজ আমাদের জানিয়েছে, তাদের কাউন্টারগুলোতে রেমিট্যান্স পাঠাতে খুব বেশি গ্রাহক আসছেন না। ফলে তারা স্বাভাবিক সময়ের মতো রেমিট্যান্স পাচ্ছে না।'
এর পরিপ্রেক্ষিতে রেমিট্যান্সের ডলারের দাম ১০-২০ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়ে ১১৮.৭০-১১৮.৮০ টাকায় উঠেছে। গত মাসে রেমিট্যান্সের ডলারের দাম ছিল ১১৮.৬০ টাকা।
বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমার পাশাপাশি হুন্ডিতে রেমিট্যান্স আসা গত সপ্তাহখানেক ধরে অনেক বেড়েছে মন্তব্য করে এ ব্যাংকার বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), সৌদি আরবের মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স কমার পাশাপাশি হুন্ডিতে লেনদেন অনেক বেড়ে গেছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো অনেক গ্রাহক হুন্ডিতে টাকা পাঠাচ্ছেন। হুন্ডির এই বাড়তি চাহিদা অর্থ পাচার বাড়াচ্ছে। ফলে এর চূড়ান্ত সুফল পাচ্ছেন অর্থ পাচারকারীরা।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'গত সপ্তাহখানেক ধরে ব্যাংকিং খাতে রেমিট্যান্স খুব ভালো আসছে না। ব্যাংক ও ইন্টারনেট কয়েকদিন বন্ধ থাকায় একটা নেতিবাচক প্রভাব কাজ করছে। এই পরিস্থিতি সাময়িকও হতে পারে। তবে এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পেতে আমাদের আরও কিছুদিন নিবিড়ভাবে বাজার পর্যবেক্ষণ করতে হবে।'
আমদানি এলসি খোলাও কমেছে
রেমিট্যান্স প্রবাহ কমায় ডলারের জোগান কমার পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আমদানি এলসি খোলার চাহিদাও কমে গেছে।
একাধিক ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বড় ব্যবসায়ীরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, সেটি নিশ্চিত হওয়ার পরই নতুন বিনিয়োগের চিন্তায় আছেন তারা। বিশেষ করে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খুব একটা খোলা হয়নি গত কয়েকদিনে। একইসঙ্গে রপ্তানি অর্ডার কমে আসায় তৈরি পোশাক খাতে কাঁচামাল আমদানির চাহিদাও কমে এসেছে।
এ কারণে বড় আমদানিকারকদের অনেকেই এখন নতুন আমদানি এলসি খুলছেন না। ফলে মাস শেষে আমদানি এলসি খোলার পরিমাণ কমে যেতে পারে বলে জানান তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, দেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো জুনে ৫.১৭ বিলিয়ন ডলারের আমদানি এলসি খুলেছে। মে মাসে এ পরিমাণ ছিল ৬.৮৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ৬৮.১৯ বিলিয়ন ডলারের আমদানি এলসি খোলা হয়েছে, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৬৬.৯৫ বিলিয়নের চেয়ে ১.৮৫ শতাংশ বেশি।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, 'স্বাভাবিক সময়ে আমরা সাধারণত প্রতি কার্যদিবসে ৭-৮ মিলিয়ন ডলারের এলসি খুলি। তবে সাধারণ ছুটি শেষে গত সপ্তাহের শেষ দুই দিনে আমরা গড়ে ১-১.৫ মিলিয়ন ডলারের এলসি খুলেছি। রোববার প্রায় ৫ মিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে।'
এই ব্যাংকার বলেন, 'আমাদের কাছে গত কয়েকদিনে ছোট আমদানিকারকেরা এলসি খোলার জন্য আসছেন। তারা মূলত কনজিউমার আইটেম, ফিনিশড মেটাল, হার্ডওয়্যার, বেবিফুডের মতো পণ্যের এলসি খুলছেন। তবে বড় আমদানিকারকদের পক্ষ থেকে এলসি খোলার চাহিদা তেমন পাচ্ছি না।'
আমদানি এলসি খোলার চাহিদা কম থাকায় রেমিট্যান্স কম আসার পরও ব্যাংকিং খাতে ডলারের তারল্য পরিস্থিতি ভালো আছে বলে জানা গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুন শেষে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ডলারের তারল্য ছিল ৬.১ বিলিয়ন ডলার, যা আগের মাসের চেয়ে ১ বিলিয়ন ডলার বেশি।
ইস্টার্ন ব্যাংক-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার বলেন, কয়েকদিন ব্যাংক বন্ধ ছিল। এছাড়া ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে সুইফট ব্যবহার করা যায়নি। ইন্টারনেট বন্ধ থাকলে রেমিট্যান্স, আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানো যায় না। ইন্টারনেট চালু হওয়ার পর থেকে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানো যাচ্ছে। তবে শুরুতে তারা একটা গতির মধ্যে ছিলেন, এটা কিছুটা ধীর হয়ে গেছে; ফলে ব্যবসা একটু ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে যখন অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাড়বে, তখন ব্যবসার গতি বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।