নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা সত্ত্বেও রেমিট্যান্সে ডলারের দর বেড়ে দাঁড়াল ১২৩ টাকায়
বুধবার (২৯ নভেম্বর) ডলারের আনুষ্ঠানিক দর কমিয়ে ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো যা কমানো হয়। কিন্তু, এভাবে নিয়ন্ত্রণের সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, মাত্র একদিন পরেই বৃহস্পতিবার রেমিট্যান্স সংগ্রহে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৩ টাকায়।
বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃহষ্পতিবার কিছু ব্যাংক সর্বোচ্চ ১২৩ টাকা দরে রেমিট্যান্সের ডলার কিনেছে। বুধবার তারা সর্বোচ্চ ১২১ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১২২ টাকা পর্যন্ত দরে রেমিট্যান্সের ডলার কিনেছিল। আবার অনেক ব্যাংক ১১৮ থেকে ১১৯ টাকা দরে কিছু রেমিট্যান্সের ডলার কিনতে পারলেও– এ লেনদেনের পরিমাণ স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কমই ছিল।
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বেড়েছে ডলারের দাম। এই ধারাবাহিকতা ভেঙে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) এবং বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) রেমিট্যান্স সংগ্রহে ডলারের দর ৫০ পয়সা কমানোর ঘোষণা দেয়। কিন্তু, তার একদিন পরেই গত ২৩ নভেম্বরে বাজারের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ব্যাংকগুলো দর কমানোর পরিবর্তে আগের দিনের চেয়েও ৩ টাকা বেশি হারে ডলার কিনেছে। গত ৭ নভেম্বর রেমিট্যান্সের ডলার দর উঠেছিল রেকর্ড ১২৪ টাকায়।
বুধবার (২৯ নভেম্বর) জারি করা এক সার্কুলারে দেশের ব্যাংকারদের শীর্ষ এ দুটি সংগঠন – এবিবি ও বাফেদা – রেমিট্যান্সে ডলারের দাম আরও ২৫ পয়সা কমানোর ঘোষণা দেয়। এতে রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্সের ডলার কেনার দর ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা নির্ধারণ করার কথা জানানো হয়, যা আগে ছিল ১১০ টাকা। এ ছাড়া, আমদানি দায় মেটাতে ডলার বিক্রির দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১১০ টাকা ২৫ পয়সা, যা আগে ছিল ১১০ টাকা ৫০ পয়সা।
আগামী রোববার থেকে ব্যাংকগুলো নতুন এ দর কার্যকর করবে।
এর আগে গত ২২ নভেম্বরে সংগঠন দুটি ৫০ পয়সা কমিয়ে আমদানি দায় নিষ্পত্তির জন্য প্রতি ডলারের দর ১১০ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করে। আর রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স সংগ্রহে তা ১১০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
অবশ্য ডলার কিনতে নির্ধারিত এই হারের চেয়ে সর্বোচ্চ ২.৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রণোদনা ব্যাংকগুলোকে নিজস্ব তহবিল থেকে দেওয়ার মৌখিক নির্দেশনা দেয় বাফেদা। সে অনুযায়ী, সর্বোচ্চ ১১২ টাকা ৫০ পয়সা দরে ডলার কিনতে পারবে ব্যাংকগুলো। কিন্তু, বর্তমানে তারা এর চেয়েও ১০ টাকা বেশি দরে ডলার কিনছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলারের রেট রিপোর্টিং করার ক্ষেত্রে কম দেখানো হচ্ছে।
বাফেদা নির্ধারিত দরে ডলার বিক্রি করার কথা থাকলেও– ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত এই দাম আমদানিকারকদের থেকে আদায় করছে। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ডলারের দাম কমানোর প্রচেষ্টা সফল হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।
আমদানিকারকদের মতে, এলসি খোলার ক্ষেত্রে ডলারের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৮ টাকায়।
দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় ভোজ্যতেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান জানায়, এক সপ্তাহ আগে প্রায় ৬ কোটি ডলারের একটি এলসি খুলেছে তারা, যা নিষ্পত্তি করতে প্রতিডলারে ১২৭ টাকা ৯৫ পয়সা দিতে হবে ব্যাংককে।
কোম্পানিটির একজন নীতি-নির্ধারক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'এলসি খোলার সময় বাড়তি দর দেওয়ার পাশাপাশি এখন আমাদের ১২০ শতাংশ ক্যাশ মার্জিন ব্যাংকে জমা দিতে হচ্ছে। ভবিষ্যতে ডলারের দাম আরও বাড়বে এই যুক্তি দিয়ে ব্যাংকগুলো এভাবে মার্জিন জমা নিচ্ছে। পর্যাপ্ত ডলার না থাকায়– ব্যাংকে এলসি খুলতে গেলেই আমরা উচ্চ মার্জিন দিতে বাধ্য হচ্ছি।'
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, এলসি কনফার্মেশন চার্জ এবং ডলারের সুদহারও আগের তুলনায় অনেকটা বেড়েছে। বাড়তি এই খরচে প্রভাবিত হচ্ছে আমদানি পণ্যের দাম। ফলে ভোক্তাদের ব্যয়ও বাড়ছে।
বাফেদার নির্বাহী কমিটির সদস্য ও একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, "কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আমাদের যে নির্দেশনা দেওয়া হয়, আমরা সভার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে তা জানিয়ে দেই। বাংলাদেশ ব্যাংক চাচ্ছে, প্রতি মাসেই ডলারের রেট বাড়ানো হবে– রেমিট্যান্স প্রেরক এবং রপ্তানিকারকরা যেন এই প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসে। তবে মার্কেটে আমরা এর তেমন কোনো প্রভাব দেখতে পাচ্ছি না। বাফেদা নির্ধারিত রেটে তেমন ডলার পাওয়া যাচ্ছে না।"
ব্যাংকগুলোর কাছে রেমিট্যান্সের ডলার কেনাবেচা করা একটি এক্সচেঞ্জ হাউজের কর্মকর্তা বলেন, "আমরা বর্তমানে রেমিট্যান্সের ডলারের রেট বাড়ার প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি। বৃহষ্পতিবার আমরা ১২২ টাকা ৮০ পয়সা দরে প্রতি ডলার কিনে ১২৩ টাকায় ব্যাংকগুলোর কাছে রেমিট্যান্স বিক্রি করেছি। তবে কিছু রেমিট্যান্স এগ্রিগেটর ব্যাংকগুলোর কাছে আরো বেশি রেট পাচ্ছে বলে শুনেছি।"
হুন্ডি চ্যানেলে ডলারের দর বেড়ে গেলে– তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে বেশি দরে রেমিট্যান্সের ডলার সংগ্রহ করা হয় উল্লেখ করেন আরেকটি প্রভাবশালী এক্সচেঞ্জ হাউজের কর্মকর্তা।তিনি বলেন, "তাই আমাদেরও বাধ্য হয়ে রেট বাড়াতে হয়। অতীত অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, রেমিট্যান্সের ডলারের রেট বাড়লে রেমিট্যান্স আসার প্রবাহও বাড়ে। অনেক সময় ব্যাংকগুলো আমাদের কাছে বেশি রেট দিয়ে হলেও ডলার নিতে চায়। রেট বেড়ে যাওয়ার এটিও একটি বড় কারণ।"
একটি বেসরকারি ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তা বলেন, বাফেদা নির্ধারিত রেটে খুব বেশি রেমিট্যান্স পাওয়া যায় না। তবে অনেক ব্যাংকেরই ডেফার্ড এলসির পেমেন্ট ও ওভারডিউ পেমেন্ট বেশি। এসব পেমেন্ট করতে তারা রেট বেশি দিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি নভেম্বরের ২৪ তারিখ পর্যন্ত দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৪৯ কোটি ডলার, এর আগে অক্টোবরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৯৮ কোটি ডলার।