রিজার্ভ ও রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার শর্ত শিথিল করতে রাজি হয়েছে আইএমএফ
৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্যাকেজের আওতায়, রিজার্ভের অর্জনের যে লক্ষ্যমাত্রার শর্ত দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), তা সংশোধনে রাজি হয়েছে।
আইএমএফ মিশনের সাথে আলোচনায় জড়িত অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তার মতে, বৈশ্বিক ঋণদাতাটি ফরেক্স রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৬.৭ বিলিয়ন ডলার কমিয়ে– ২০২৪ সালের জুন নাগাদ ২০.১৯ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ গঠনের নতুন লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেবে।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রথমসারির পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশ যখন পশ্চিমা দেশগুলোয় চাহিদা কমে যাওয়ার সম্মুখীন; মূল্যস্ফীতি ও সার, জ্বালানি ও শিল্প কাঁচামাল আমদানির উচ্চ ব্যয় যখন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে– তারমধ্যেই আইএমএফের সাথে আলোচনায় এ অগ্রগতি এলো।
আলোচিত এসব চ্যালেঞ্জের কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্র রিজার্ভের ক্ষয় হয়েছে, এবং গেল বছরের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বাংলাদেশি টাকার ৩৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন ঘটেছে।
আইএমএফের ঋণ পর্যালোচনা মিশন বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছে। মঙ্গলবার (১৭ অক্টোবর) মিশন কর্মকর্তাদের সাথে এক বৈঠকে অংশ নেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। বৈঠকে আইএমএফ মিশন চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ সরকারকে রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছিল, সেটিও কমাতে রাজি হয়েছে।
তবে সরকারের প্রাইমারি ব্যালেন্স বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইএমএফ।
অর্থনীতিবিদেরা ঋণ কর্মসূচির কিছু শর্ত শিথিলের আইএমএফের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও, সতর্ক করে বলেছেন, যথাযথ ব্যবস্থাপনা ছাড়া নতুন লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জন করাও কঠিন হবে।
এ বছরের শুরুতে আইএমএফ সেপ্টেম্বর নাগাদ ২৫.৩৪ বিলিয়ন ডলারের নিট বা প্রকৃত ফরেক্স রিজার্ভ গঠনের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু, আইএমএফের রিজার্ভ হিসাব করার পদ্ধতির ষষ্ঠ সংস্করণ বিপিএম৬ (BPM6) অনুযায়ী, বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ ২১.১৫ বিলিয়ন ডলার। নিট হিসাব করলে এই পরিমাণ আরও কমে ১৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, 'আগামী বছরের জুন নাগাদ বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ২৬.৮১ বিলিয়ন ডলার রাখার শর্ত দিয়েছিলো আইএমএফ। আগের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে তা থেকে কমিয়ে জুন নাগাদ তা ২০.১৯ বিলিয়ন ডলার করার বিষয়ে রাজি হয়েছে আইএমএফ। এই সংশোধন বাংলাদেশের জন্য বড় স্বস্তি হয়ে এলো।'
এর আগে গত ৪ অক্টোবর ঢাকায় আসেন আইএমএফের ঋণ পর্যালোচনা মিশনের সদস্যরা। এরপর তারা বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)- সহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সাথে বৈঠক করছেন। আগামী ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত মিশনটি বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাবে।
মিশন শেষ হওয়ার শেষদিনে এসব আলোচনার ফলাফল জানাবেন আইএমএফ মিশনের কর্মকর্তারা। বাংলাদেশের বিষয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতে ১৯ অক্টোবর একটি সংবাদ সম্মেলন করবেন তারা।
মঙ্গলবার মিশনের সাথে বৈঠকের আগে অর্থ সচিব ড. খায়রুজ্জামান মজুমদার যেসব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাকে আইএমএফের শর্ত পরিপালন করতে হচ্ছে তাদের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে আগামী জুনের মধ্যে সংস্থাগুলো তাদের সংশ্লিষ্ট টার্গেট কতটা অর্জন করতে পারবে, তা জানতে চান অর্থ সচিব। সংস্থাগুলোর মতামত নিয়ে দুপুরে আইএমএফ মিশনের সাথে বৈঠকে অংশ নেন অর্থ সচিব। সেখানে রিজার্ভ, রাজস্ব আয় ও সরকারের প্রাইমারি ব্যালেন্স নিয়ে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে।
আইএমএফ মিশনের সাথে বৈঠকে অংশ নেওয়া বাংলাদেশি কর্মকর্তারা তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, জরুরি আমদানির ব্যয়, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ, বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি এবং রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বিবেচনায় আগামী বছরের জুন নাগাদ বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে এটি কমাতে সম্মতি দেয় আইএমএফ।
রাজস্বের নতুন লক্ষ্যমাত্রা
ঋণ কর্মসূচির একটি শর্ত হিসেবে, প্রাথমিকভাবে চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৪ লাখ ১০ হাজার ৪০০ কোটি টাকার কর রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল আইএমএফ।
কিন্তু, আইএমএফ মিশন সদস্যদের সাথে বৈঠকে নির্বাচনী বছরে এই টার্গেট অর্জন কঠিন হবে বলে জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এরপর আইএমএফ এই লক্ষ্য কমিয়ে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যদিও অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করছেন, সংশোধিত এই লক্ষ্য অর্জনও কঠিন হবে। কারণ আমদানি নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়ার সুযোগ কম। আবার কর ছাড়ও কমানো যাবে না। ফলে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব সংগ্রহে বড় ধরনের উলম্ফন সম্ভব না।
গত অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আইএমএফ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব কম আদায় করেছে। তাই চলতি অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে হবে এনবিআরকে। কিন্তু, অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেও ৬১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের প্রতিশ্রুতি পূরণে পিছিয়ে আছে এনবিআর।
প্রাইমারি ব্যালেন্স
সরকারের প্রাইমারি ব্যালেন্সে ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ইতঃপূর্বে ১ লাখ ৬২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা রেখেছিল আইএমএফ, যা এখন ১ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে।
প্রাইমারি ব্যালেন্স হচ্ছে, সরকারি ঋণের উপর নিট সুদ প্রদান ব্যতীত রাজস্বের ভারসাম্য। এক কথায়, এটি হলো সরকারের রাজস্ব আয় এবং সরকারিভাবে পণ্য এবং পরিষেবাগুলোর পেছনে ব্যয়ের মধ্যে পার্থক্য।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, আইএমএফ মিশনের প্রতিনিধিরা তাদের বক্তব্য ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। ফলে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় নিয়ে কোনো সমস্যা হবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে আইএমএফের বোর্ডে।
আইএমএফের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা– পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, 'আইএমএফ বাস্তবসম্মতভাবে চিন্তা করছে। নীতি ব্যবস্থাপনা, জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগুলোর ওপর আমাদের আগামী দিনের অবস্থা নির্ভর করবে। এজন্য টার্গেট রিভাইস করার কারণে উচ্চাভিলাষী হওয়া ঠিক হবে না। সঠিক ব্যবস্থাপনা করা না গেলে নতুন টার্গেট অর্জনও কঠিন হতে পারে।'
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, বাস্তবতার নিরিখে আইএমএফ রিজার্ভ সংরক্ষণ ও রাজস্ব আয়ের টার্গেট পুনঃনির্ধারণ করছে। কারণ আগামী বছরের জুন শেষে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এজন্য আইএমএফ চাচ্ছে বর্তমানে যে রিজার্ভ রয়েছে, সেটা যাতে আরও না কমে। বরং জুন নাগাদ যেন সামান্য হলেও বাড়ে, সে লক্ষ্য নিয়েছে।
তিনি বলেন, 'রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে বাজারে ডলার সরবরাহ বন্ধ করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতে পারে– তাহলে জরুরি পণ্যের আমদানি দায় পরিশোধ হবে কীভাবে? এজন্য রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে; এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করতে হবে। এর পাশাপাশি সরকারকে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর থেকে বাজেট সহায়তা ও ব্যালেন্স অব পেমেন্ট সহায়তা নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এ ধরনের সহায়তা বাবদ যে অর্থ পাওয়া যাবে এবং সেগুলো যদি খরচ করা না হয় তাহলে রিজার্ভ বাড়বে।'
রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য অর্জনে তিনি কর ছাড় কমানোর পরামর্শ দেন।
প্রাইমারি ব্যালেন্স- এর বিষয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, প্রাইমারি ব্যালেন্স আইএমএফ আগের তুলনায় বাড়ালেও তা বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম। অর্থাৎ, এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকারকে রাজস্ব আয় বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যয় কমাতে হবে।
আইএমএফের ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ
আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে। ৪২ মাস ধরে ৭ কিস্তিতে এই ঋণ ছাড় করবে সংস্থাটি। এই ঋণের জন্য আইএমএফ বাংলাদেশের ব্যাংক, রাজস্ব, পরিবেশসহ বিভিন্ন খাতে ৩৪টি টার্গেট দিয়েছে। যারমধ্যে বেশিরভাগ সংস্কার কার্যক্রম, বাকিগুলো আর্থিক লক্ষ্যমাত্রা।
চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি আইএমএফের বোর্ড এই ঋণ অনুমোদন করে। এরপরের দিনই ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭৬.২৭ মিলিয়ন ডলার ছাড় করে। বর্তমানে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের অপেক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশ। এ কিস্তি ছাড়ের আগে আইএমএফের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ এর নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি মিশন বাংলাদেশ শর্তগুলোর কতটা বাস্তবায়ন করেছে– তা যাচাইয়ে ঢাকা সফর করছে।
দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে আইএমএফকে যেসব শর্ত বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বাংলাদেশ, তার বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ রাখা, রাজস্ব আয় এবং পেট্রোলিয়াম পণ্যের জন্য সময়ে সময়ে ফর্মূলা-ভিত্তিক মূল্য সমন্বয় পদ্ধতি চালুর শর্ত পরিপালন করতে পারেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংক, রাজস্ব বোর্ড ও জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা আইএমএফ মিশনের সাথে বৈঠকে এই ব্যর্থতার পেছনে বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। তারা জানান, নিম্ন আমদানি ও সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন ধীরগতির ফলে রাজস্ব সংগ্রহ কম হয়েছে। একইভাবে সার, খাদ্য, জ্বালানির মত জরুরি পণ্য আমদানি করতে গিয়ে প্রতি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংককে এক বিলিয়ন ডলার দিতে হচ্ছে।