এপ্রিলে ব্যাংক খাত থেকে চলতি অর্থবছরের সর্বোচ্চ ২৯,৬৯৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার
চলতি অর্থবছর প্রায় শেষে এসে নিজেদের তহবিল সুরক্ষিত করতে দেশের ব্যাংক খাত, বিশেষ করে কেন্দ্রিয় ব্যাংকের দিকে ঝুঁকছে সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে দেখা যায়, সরকার এপ্রিল মাসে ব্যাংক খাত থেকে ২৯,৬৯৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে; যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের কোনো মাস থেকে নেওয়া সর্বোচ্চ ঋণ।
মার্চে সরকার ঋণ নেয় ১৭,৭৭০ কোটি টাকা, ফেব্রুয়ারিতে নেয় ৬,৮০৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে সরকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে মোট ৮২,০৫৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে এবং এই ঋণের প্রায় ৮০% কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরবরাহ করেছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেয়, তখন সেটিকে হাই-পাওয়ার্ড মুদ্রা বলা হয়। এর ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হতে পারে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যে ধার নেওয়া হয়েছে, সেটা হাই পাওয়ার্ড মানি। এটার একটা ইনফ্লেশনারি ইফেক্ট তো আছেই অর্থনীতিতে। এছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেওয়া লোন প্রাইভেট সেক্টরে লোনেবল ফান্ডের পরিমাণ কমিয়ে দেব।"
"তবে রাজস্ব আয় টার্গেটের চেয়ে কম হওয়ায় সরকারকে খরচ মেটানোর জন্য লোন করতে হচ্ছে। কীভাবে দেশীয় সম্পদ সংগ্রহ বাড়িয়ে সরকারের খরচ কমানো যায়, সেদিকটাতে এখন সরকারকে বেশি মনযোগ দিতে হবে," তা না হলে ইনফ্লেশনকে কন্ট্রোল করা চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মন্তব্য করেন এ অর্থনীতিবিদ।
বিশ্লেষকদের ধারণা, ব্যাংক খাত থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ চলতি অর্থবছরে ১,০৬,৩৩৪ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩.৫৬ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেওয়া হয়েছে ২ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, চলতি অর্থবছরের অধিকাংশ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ বাড়লেও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ পরিশোধের দিকে সরকারের ঝোঁক ছিল। তবে মার্চ ও এপ্রিলে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণও কিছুটা বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া অর্থের একটি বড় অংশ সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই ভল্ট থেকে টাকা বের করে সেগুলো কিনে নেয়; এই টাকার একটি অংশ আবার নতুন টাকা ছাপানোর মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। একে বলা হয় 'অদলবদল'।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এপ্রিলে ১১,০০০ কোটি টাকার বেশি অদলবদল করেছে। অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে মোট অদলবদল ৬৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।
এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে সরকারকে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ কমিয়ে ব্যাংক বহির্ভূত খাত থেকে ঋণ নিতে বলা হয়েছিল।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, মূল্যস্ফীতি এখন এমনিতেই স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন অর্থ অদলবদল করে তখন দেশের অর্থনীতিতে অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি পায়। নতুন টাকা বাজারে আসলেই মুদ্রাস্ফীতির সূত্রপাত হয়।
তিনি আরও বলেন, কয়েকদিন আগে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট ছিল। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া রেপো ও তারল্য সুবিধার মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট কমে। তবে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক খাত থেকে ঋণ গ্রহণ বাড়ালে ব্যাংকিং খাতে আবারও তারল্য সংকট দেখা দিতে পারে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকিং খাত থেকে ১,০৬,৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল সরকার। এপ্রিলের শেষে সরকার এই লক্ষ্যমাত্রার ৭৭.১৭% পূরণ করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, সরকার ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে শুরু করে গত এক বছরে ব্যাংকিং খাত থেকে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যার বেশিরভাগই নেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে।
কর্মকর্তারা জানান, বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়। এ ঋণের অধিকাংশই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যয় করা হয়।
চলতি অর্থবছরে সরকার নন-ব্যাংকিং খাত থেকে ৪০,০০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। এরমধ্যে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫,০০০ কোটি টাকা এবং নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) এবং অন্যান্য উৎস থেকে ৫,০০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, এপ্রিল পর্যন্ত এনবিএফআইসহ অন্যান্য খাত থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে ৮,৮৪১ কোটি টাকা। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়া কমেছে ৪ হাজার ১৬২ কোটি টাকা।