সাগরতীরের ঠগবাজি…
কক্সবাজার বাইপাস সড়কের আদর্শগ্রাম এলাকায় ২০১২ সালে ১১০ কাঠা জমির উপর ১৮ তলা ভবন নির্মাণ কাজ শুরু করে আরএফ বিল্ডার্স। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের আদলেই যেন প্রকল্পটির নাম রাখা হয় 'হোয়াইট স্যান্ড'। বলা হয়েছিল, এই প্রকল্পে বদলে যাবে কক্সবাজার।
চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন ছিলেন হোয়াইট স্যান্ড প্রকল্পের পরিচালক। ক্রিকেটার সাকিব আল-হাসানও ২০১৮ সালে এখানে বুকিং দেন ২০,০০০ বর্গফুটের বাণিজ্যিক এরিয়া।
২০১৮ সালে ভিডিও প্রচারণায় ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন "আমার আগে সাকিব হাসান যুক্ত হয়েছেন। আমিও যুক্ত হয়েছি। আমরা চাচ্ছি, কক্সবাজারকে বদলে দিতে।"
অতি-সহজে সম্পত্তির মালিকানা লাভের সুযোগ, সাথে সুপারস্টারদের যুক্ত থাকার বিশ্বাসযোগ্যতা মিলে হাজার হাজার বিনিয়োগকারীকে আকৃষ্ট করে এ প্রকল্প। প্রতি ফ্ল্যাটের বিপরীতে ১০-১২ জন করে– ৩০০টি ফ্ল্যাট বিক্রি করা হয় প্রায় ৩ হাজার গ্রাহকের কাছে। ২৯০ থেকে ৯১০ বর্গফুটের একেকটি ফ্ল্যাট বিক্রি করা হয়- সর্বনিম্ন ৫ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকায়।
হোটেলের মালিকানা নিয়ে গর্ব করতে পারা যাবে শুধু একারণেই নয়, সাকিবের মতো মহাতারকার সাথে একই প্রকল্পে থাকার দিকটিও মানুষকে আকৃষ্ট করে। পাঁচ তারকা হোটেল ও শপিং মলে আজীবন মালিকানা ও টাইম শেয়ারিং এর মতো সুবিধার কথাও বলা হয়েছিল।
২০১৮ সালের মধ্যে শেষ হবার কথা থাকলেও এখন পুরো প্রকল্পটি দেখে মনে হয় পরিত্যাক্ত। এপর্যন্ত শুধু তিনতলা পর্যন্ত নির্মাণ হয়েছে, যা বর্তমানে গাড়ির গ্যারেজ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
কলাতলী এলাকায় এই প্রকল্পের এক কিলোমিটারের মধ্যে– একই কোম্পানির আরো চারটি প্রকল্প একইভাবে অসমাপ্ত পড়ে আছে ২০১৮ সাল থেকে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়,কয়েকটি অর্ধ-সমাপ্ত ভবনের ছড়াছড়ি। একটি প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও, বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ- চুক্তি অনুযায়ী হোটেলে থেকে লভ্যাংশ পাচ্ছেন না তারা।
অর্থাৎ, বহু স্বপ্নের সওদাগর– হোয়াইট স্যান্ড প্রকল্পে আসলে কিছুই বদলায়নি। তবে দুর্ভাগ্যের কারণ হয়েছে হাজারো মানুষের, প্রতারণা করে যাদের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেলিব্রেটিদের ব্যবহার করে, সহজে আয়ের পুরোনো এই প্রতারণার কৌশল আবারো অবলম্বন করা হয়েছে এক্ষেত্রে।
এখন ইলিয়াস কাঞ্চন নিজেই সুর বদলেছেন। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমি এখন আর এই প্রকল্পের পরিচালক নেই। কখন থেকে নাই- এত কথা বলতে পারব না। সোজা কথা আমি নাই। প্রকল্প বন্ধ আছে, যারা প্রকল্পের উদ্যোক্তা তাদের সাথে যোগাযোগ করেন।"
শুধু আরএফ বিল্ডার্স নয়, একই রকম লোভনীয় অফার দিয়ে গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা এভাবেই হাতিয়ে নিয়েছে দশটিরও বেশি আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান।
এই ১০ প্রতিষ্ঠান তাদের কমপক্ষে ২৫টি প্রকল্প কাজ শেষ না করেই ফেলে রেখেছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে যারা ফ্ল্যাট কিনেছেন- তাদের সাথে সাথে ভূমি মালিকরাও পড়েছেন বেকায়দায়।
অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম - আর এফ বিল্ডার্স, কোরাল রিফ প্রপার্টিজ, হাইপেরিয়ন বিল্ডার্স লিমিটেড, আইডিয়াল প্রপার্টিজ লিমিটেড, ওয়েসিস ডেভেলপারস লিমিটেড, গ্রিন ডেল্টা হাউজিং অ্যান্ড ডেভেলমেন্ট (প্রা.) লিমিটেড, ডায়নামিক প্রপার্টিজ, সি- স্টার প্রপার্টিজ এবং মিশন ডেভেলপার লিমিটেড।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা টিবিএসকে বলেন, 'এই ব্যবসায় সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো পলিসি ও নিয়ন্ত্রণ না থাকায়– একটি অসাধু ব্যবসায়ী চক্র ফ্ল্যাট-স্যূট ও টাইম শেয়ারিংয়ের নামে প্রতারণা করে চলেছে। এ বিষয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন ও নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। একটি স্যূট ঠিক কতজনের কাছে বিক্রি করা যাবে, তারও নিয়ম থাকা উচিত'।
তিনি বলেন, অন্তত ৫০০ মানুষের অভিযোগের তথ্য কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে রয়েছে।
এমন প্রতারণার শিকার কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল হালিম বলেন, "২০১৫ সালে আর এফ বিল্ডার্স এর 'হোয়াইট স্যান্ড' প্রকল্পে ৯১০ বর্গফুটের একটি টাইম শেয়ারিং ফ্ল্যাট কেনার চুক্তি করি ২৫ লাখ টাকায়। ৬ লাখ টাকা পরিশোধও করেছিলাম। ২০১৮ সালে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও– গত সাত বছরে ফ্ল্যাট যেমন বুঝে পাইনি, তেমনি টাকাও ফেরত পাইনি।"
তিনি আরও বলেন, 'বাবার পেনশন থেকে ফ্ল্যাট কেনার টাকা দিয়ে দিয়েছিলাম আরএফ বিল্ডার্সকে। পরিবার ভাবছে প্রতারণাটা আমি করেছি, সমাজে কাছে মুখ দেখাতে পারছি না।'
প্রতারণার নাড়িনক্ষত্র
২০১৮ সালে হোয়াইট স্যান্ড রিসোর্টের এক ফেসবুক পোস্টে 'বদলে যাচ্ছে কক্সবাজার' শীর্ষক এক অনুষ্ঠানের ছবি প্রকাশ করা হয়। এতে বাংলাদেশের বিশিষ্ট কারা সেখানে অংশ নিয়েছেন সেটাও উঠে আসে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
অনুষ্ঠানের একটি ছবিতে তার পাশে চিত্রনায়িকা মৌসুমি ও চিত্রনায়ক ওমর সানীসহ অন্যান্য সেলিব্রেটিদেরও দেখা যায়।
চিত্রনায়িকা মৌসুমীকে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক বিজ্ঞাপনে বলেন, 'ইনভেস্ট একবার, রিটার্ন (পান) বার বার'।
ডেভেলপাররা এই রকম লোভনীয় বিজ্ঞাপনে টাইম শেয়ারিং এর অফারে নির্মাণাধীন এইসব ভবনের এক একটি হোটেল কক্ষ ১০-১২ জনের কাছে বিক্রি করে। হোটেলের মালিকানার পাশপাশি সাফ-কবালায় রেজিস্ট্রেশন, বছরে ৪ থেকে ৫ দিন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ফ্রি থাকা, পার্টনার ডিসকাউন্ট অফার হিসেবে প্রায়োরিটি কার্ড– এমন নানান অফার দেওয়া হয়। বছর শেষে ফ্ল্যাট ভাড়ার বিপরীতে মুনাফা হিসেবে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা দেয়ার কথা বলা হয়।
তাদের প্রমোশনে সরকারের মন্ত্রী, জাতীয় দলের খেলোয়ার, চিত্র নায়ক-নায়িকা ও শিল্পীদের উপস্থিতি সহজেই মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে। আর এভাবেই ফাঁদ পাতা সম্পন্ন হয়।
আবদুল হালিমের মতোই আরএফ বিল্ডার্সের একই প্রকল্পের আরেক গ্রাহক আবুল খায়ের- এই চাকচিক্যময় প্রতারণার শিকার।
তিনি ২৯০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের জন্য ২০১৪ সাল পর্যন্ত পরিশোধ করেন ১৬ লাখ টাকা। ফারহানা চৌধুরী লুসি ২৪৫ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের জন্য ১০ লাখ টাকা এবং সৈয়দ রফিকুল হক ৩০৫ বর্গফুটের ফ্লাটের বিপরীতে ১২ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন।
২০১২ সালে কলাতলী প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় 'আর এফ ওয়ার্ল্ড ভিউ' ও 'কক্সবাজার সেন্ট্রাল মল' নামে দুটি প্রকল্প শুরু করে আরএফ বিল্ডার্স। সেন্ট্রাল মল-নামের প্রকল্পটির জন্য আধাআধি (ফিফটি/ফিফটি) মালিকানার ভিত্তিতে ২২ কাঠা জমি আরএফ বিল্ডার্সকে দিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল মালেক। কিন্তু, গত ১২ বছরে পাইলিং ছাড়া কিছুই করেনি ডেভলপার প্রতিষ্ঠান।
ভূমি মালিক আবদুল মালেক টিবিএসকে বলেন, '২০১৫ সালের মধ্যে ১৫ তলা ভবন তৈরি করে আমাদের অংশ বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। গত দশ বছরে অন্তত দশটি আইনি নোটিশ পাঠিয়েছি, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী, আমরা আরএফ- এর কাছে ভবনের ৫০ শতাংশ মালিকানা ছাড়াও প্রায় তিন কোটি টাকা ভাড়া পাই।'
আরএফ ওয়ার্ল্ড ভিউ প্রকল্পের ভূমি মালিক হলেন তিন বোন- গুলবাহার বেগম , নূর নাহার বেগম ও রাবেয়া খাতুন। চুক্তি অনুযায়ী, এই প্রকল্পে জমির বিনিময়ে তারা নগদ ৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ও ৮০০ বর্গফুটের নয়টি ফ্ল্যাট পাওয়ার কথা।
কিন্তু, গত দশ বছরেও ভূমি মালিকদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি।
আরএফ বিল্ডার্স- এর পরিচালক ওমর ফারুক টিবিএসকে বলেন, করোনা মহামারি ও বৈশ্বিক মন্দার কারণে আমাদের কয়েকটি প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি। তবে বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রকল্পগুলোতে যারা বিনিয়োগ করেছিলেন- তাদের অন্য প্রকল্পে ফ্ল্যাট দেওয়ার প্রস্তাব করা হচ্ছে।
তবে মোহাম্মদ ফারুকের এই বক্তব্য মানতে নারাজ ভুক্তভোগী গ্রাহকেরা। অনেকে বলছেন, প্রকল্পগুলো করোনার আগে থেকেই বন্ধ রয়েছে। ফ্ল্যাট তো অনেক দূরের বিষয়, বিনিয়োগকৃত টাকা ফেরতের নামে যে চেকগুলো গ্রাহকদের দেওয়া হয়েছে- সেগুলোই এখনো পাশ হয়নি।
চারিদিকেই প্রতারণার ছড়াছড়ি
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (রিহ্যাব)- এর সদস্য আইডিয়াল প্রপার্টিজ লিমিটেড সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ইনটারন্যাশনাল হোটেল চেইন মুভএনপিক- এর নামে ভবন নির্মাণের প্রচারণা চালিয়ে ২০১১ সাল থেকে ফ্ল্যাট বিক্রি শুরু করে।
দক্ষিণ কলাতলীতে ২৪ তলা ভবনে ফ্ল্যাট প্রাপ্তির অফারে ৪ হাজার গ্রাহকের কাছে টাইম শেয়ারিং স্লট বিক্রি করে তাদের থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা নেয় আইডিয়াল প্রপার্টিজ।
প্রতিটি স্যূটের বিপরীতে এককালীন বিনিয়োগ করেন ২০ জন। কিন্তু, পাঁচতলা পর্যন্ত ভবন তোলার পর ২০১৫ সালের মাঝামাঝি পুরোপুরি হয়ে যায় প্রকল্পটি।
আইডিয়াল প্রপার্টিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান। বিভিন্ন সূত্রের মতে, বর্তমানে তিনি আমেরিকায় বসবাস করছেন।
বিষয়টি সমাধানের ভার তাই রিহ্যাবেরই নেওয়ার কথা থাকলেও সংস্থাটি কিছুই করছে না। বিনিয়োগকারীরা জানান, রিহ্যাব এখন সব ধরনের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে।
রিহ্যাবের চট্টগ্রাম অঞ্চলের সদস্য আব্দুল গাফফার বলেন, "অনেক গ্রাহক রিহ্যাবের কাছে আবেদন করেছে। কিন্তু, আমরা কিভাবে সমাধান করব, কোম্পানির মালিক দেশে নাই। আর এই কোম্পানি রিহ্যাবের সদস্যপদ নবায়নও করেনি।"
ভবনের বেজমেন্টটি ব্যবহার হচ্ছে অটোরিকশারগ্যারেজ হিসেবে। বর্তমানে এটির দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দা শাহিনুর হিরা।
হিরা বলেন, '২০১৭ সাল থেকে এই ভবনের দেখভালের দায়িত্বে আছি। প্রতিমাসেই দুই থেকে চারজন মানুষ আসেন, যারা ভবন নির্মাণকালীন সময়ে বিনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু, আমি তাদের কোনো জবাব দিতে পারি না'।
এই প্রকল্পের সাবেক ম্যানেজার রবিন মজুমদার বলেন, "আমাদের দায়িত্ব ছিল স্লট বিক্রি করা, যা আমরা করেছিলাম। প্রায় দুই হাজার মানুষ প্রকল্পটিতে বিনিয়োগ করে। কিন্তু, ২০১৫ সালে হঠাত করেই প্রকল্পটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমার নিজেরই আইডিয়াল প্রপার্টিজের কাছে চার লাখ টাকা পাওনা আছে। আমার সহকর্মীদের অনেকে এই প্রজেক্টে বিনিয়োগ করেছিলেন। তারা বিনিয়োগ-বেতন সব হারিয়েছে।"
প্রতারণার আরেক দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে কোরাল রিফ লিমিটেড। তাদের দুটি প্রকপ্লের মধ্যে একটির কাজ ২০১৪ সালে শেষ হয়ে বর্তমানে বেস্ট ওয়েস্টার্ন নামে পরিচালিত হচ্ছে।
২,৫০০ জনের থেকে ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ সংগ্রহ করে হোটেলটি নির্মাণ করা হয়। হোটেল চালুর আট বছর পরেও বিনিয়োগকারীদের হোটেল স্যুট বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। এজন্য কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং সিলেটের বিভিন্ন আদালতে মামলা হয়েছে। আবার যারা স্যুটের রেজিস্ট্রি পেয়েছেন তাদের অভিযোগ– চুক্তি অনুযায়ী টাকা না পাওয়ার।
এই ডেভেলপার কোম্পানির দ্বিতীয় প্রকল্প– বিচ ক্লাব। কয়েকশত গ্রাহকের কাছে এর শেয়ার বিক্রি করা হয়। ২০১৯ সালের মধ্যেই এটি সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও নির্মাণ কাজই এখনো শুরু হয়নি।
বিচ ক্লাব থেকে স্লট ক্রেতা মুস্তাফিজুর রহমান জানান, তিনি পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছেন। ২০২১ সালের মধ্যে তার মতো প্রায় পাঁচশত গ্রাহককে হোটেলটির স্লট বুঝিয়ে দেয়ার কথা থাকলেও এখনো নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি।
কোরাল রিফ স্লট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি (চট্টগ্রাম) শামসুল আনোয়ার খান বলেন, ১০ বছর পরও রেজিস্ট্রি পায়নি বেশিরভাগ গ্রাহক। যাদের রেজিস্ট্রি দেয়া হয়েছে, তাদের চুক্তি অনুযায়ী লভ্যাংশ দেয়া হচ্ছে না। স্লট মালিকদের বছরে ১ লাখ টাকা লভ্যাংশ দেওয়ার কথা থাকলেও, দেয়া হচ্ছে ২ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার টাকা। পূর্ব প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও অনেক স্লট মালিক বছরে এক দিনও হোটেলে থাকার সুযোগ পাননি।
জানতে চাইলে কোরাল রিফের পরিচালক (অপারেশন) কামরান দিদার বলেন, "হোটেলের (বেস্ট ওয়েস্টার্ন) ২ হাজার ৪২৫টি স্লটের মধ্যে আমরা ২,২০৮ জনকে রেজিস্ট্রি দিয়েছি। বুকিং দেয়া ১৬০টি স্লটের পেমেন্ট বাকি থাকায়, তাদের রেজ্রিস্ট্রি দেয়া হয়নি। যথাযথ লভ্যাংশ না দেওয়ার বিষয়ে অভিযোগটি সত্য নয়, কারণ স্লট মালিকদের রেজিস্ট্রি দেওয়ার পর হোটেল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কোরাল রিফের আর কোনো করণীয় নেই। কারণ ২০১৪ সালেই স্লট মালিকদের উপস্থিতিতে গ্র্যান্ড হেরিটেজ নামে স্বতন্ত্র একটি প্রতিষ্ঠানকে হোটেল পরিচালনার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়।"
তিনি আরও বলেন, বিচ ক্লাবের প্রায় ৭০ জন গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে এবং বাকিদের অন্য প্রকল্পে শেয়ার দেওয়া হচ্ছে।
তবে শামসুল আনোয়ার খান বলেন, কোরাল রিফের পরিচালকের বক্তব্য সঠিক নয়।
নতুন বোতলে, পুরোনো আরক
২০০৮ সালের দিকে কক্সবাজারের দক্ষিণ কলাতলীতে 'সমুদ্র বিলাস' নামে একটি হোটেল নির্মাণের কাজ শুরু করে গ্রিন ডেল্টা হাউজিং অ্যান্ড ডেভেলমেন্ট (প্রা:) লিমিটেড।
১০ বছর বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি গ্রিন ডেল্টা'র 'সমুদ্র বিলাশ' প্রকল্পটি চালু করা হয়েছে নতুন নামে। 'বে স্যান্ডস হোটেল' নাম দিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে-সম্প্রতি আয়োজন করা হয় আবাসন মেলার। ওই অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিতি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রীও।
অথচ ১০ বছর আগে নেওয়া এই প্রকল্পটির অন্তত ২০০ গ্রাহক এখনো তাদের পাওনা বুঝে পাননি।
গ্রিন ডেল্টা'র প্রতারণার শিকার বিশ্বজিত পাল বলেন, 'চুক্তির শর্ত অনুসারে- ফ্ল্যাট ক্রয়ের বুকিং মানিসহ সাড়ে ১৭ লাখ টাকা নগদে দিয়েছিলাম। কিন্তু, ফ্ল্যাট হস্তান্তরের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও প্রতিষ্ঠানটি এ্যাপার্টমেন্ট বুঝিয়ে দেয়নি।'
পিছিয়ে নেই হাইপেরিয়ন বিল্ডার্স লিমিটেডও। গত এক যুগে প্রতিষ্ঠানটি ১১টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও এর প্রতিটি নিয়ে প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে।
যেমন ২০১০ সালে কলাতলীতে 'সান কোস্ট' নামক তিন তারকা মানের একটি হোটের তৈরির ঘোষণা দিয়ে প্রায় ৬০০ গ্রাহকের কাছে স্লট বিক্রি করা হয়। বিনিয়োগকারীদের থেকে প্রায় ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা নেওয়া হলেও- গত ১২ বছরেও ভবনটির কাজ শেষ হয়নি।
সম্প্রতি সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গ্রাহকদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দিয়েই ভবনটি ইতোমধ্যে বিক্রি করে দিয়েছে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানটি।
সান কোস্ট ছাড়াও হোয়াইট প্লেস, ওয়াটার ভিউ, সি-ওয়েভ, বে-কুইন, সি-ওয়ার্ল্ডসহ একাধিক হোটেলে টাইম শেয়ারিং ভিত্তিতে গ্রাহকদের ফ্ল্যাট-স্লট বিক্রি করা হলেও কোথাও গ্রাহকদের পাওনা ঠিকঠাক বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। প্রতারণার অভিযোগে, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক মামলা হয়েছে হাইপেরিয়নের চেয়ারম্যান শামসুল আলমের বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে কথা বলতে হাইপেরিয়ন ডেভলাপার লিমিটেড এর চেয়ারম্যান শামসুল আলমের মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। এসএমএস পাঠালেও জবাব দেননি তিনি।
শামসুল আলমের ছোট ভাই শরিফুল ইসলাম মিন্টু বলেন, যারা এখানে বিনিয়োগ করেছে এবং ফ্ল্যাট পাননি, তাদেরকে আমরা অন্য প্রকল্পে বুঝিয়ে দেব।