বাংলাদেশকে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে আইএমএফ, ফেব্রুয়ারিতে আসবে প্রথম কিস্তি: অর্থমন্ত্রী
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে সাত কিস্তিতে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
বুধবার (৯ নভেম্বর) ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান তিনি।
অর্থমন্ত্রী বলেন, "আমরা যেভাবে চেয়েছিলাম ঠিক সেভাবেই ঋণ পাচ্ছি। মোট ৪.৫ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়া হবে।"
"এই ঋণ ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সাত কিস্তিতে বিতরণ করা হবে। ঋণের প্রথম কিস্তি আসবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে।"
"ঋণের সুদের হার এটি ম্যাচিউরিটির সময় বাজারের হারের ওপর নির্ভর করবে। অর্থমন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এ হার প্রায় ২.২ শতাংশ হতে পারে।"
"আইএমএফ নন-পারফর্মিং ঋণ কমাতে এবং রাজস্ব আদায় বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে," যোগ করেন তিনি।
তবে সরকারি ভর্তুকি নিয়ে আন্তর্জাতিক অর্থঋণদাতা সংস্থাটি কিছু বলেনি বলে জানান কামাল।
তিনি আরো বলেন, "সারা বিশ্বের অর্থনীতিই এখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। উন্নত থেকে উন্নয়নশীল সকল দেশে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে। প্রায় সকল দেশের মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে কমে গিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এ উত্তাপের আঁচ আমাদের অর্থনীতিতেও কিছুটা লেগেছে। এ অস্থিরতা যাতে কোন ধরনের সংকটে ঘনীভূত না হয় তা নিশ্চিত করতেই আমরা আগাম সতর্কতা হিসেবে আইএমএফ-এর ঋণের জন্য অনুরোধ করেছিলাম।"
অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, "আইএমএফ-এর সাথে এর আগে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। চলমান ঋণ আলোচনার পর্বটি আজ আমরা সফলভাবে সমাপ্ত করলাম।"
আইএমএফ-এর সফররত দলটি বাংলাদেশ সরকারের সকল স্টেকহোল্ডার-দের সাথে আলোচনা করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় ভাল বলে তারা আমাদেরকে জানিয়েছেন।"
"আইএমএফ টিম আমাদের চলমান অর্থনৈতিক সংস্কারের সাথে একমত পোষণ করেছে। সে অনুযায়ী আমরা চার বছর মেয়াদি ঋণ কর্মসূচী নিতে যাচ্ছি।"
আইএমএফ-এর এই ঋণ কর্মসূচীর ক্ষেত্রে অর্থনীতির বহিঃখাত-কে স্থিতিশীল করা, ২০২৬ সালে এলডিসি হতে উত্তরণকে সামনে রেখে অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তি দেওয়া, আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করা এবং বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা করে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া- এই চারটি মূল লক্ষ্য হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
পাশাপাশি তিনি দেশের চলমান সংস্কার কার্যক্রমের বিষয় উল্লেখ করে বলেন, "সরকারের বাজেট ঘাটতি ধারণযোগ্য পর্যায়ে রাখা হবে, যা গত প্রায় ১৪ বছর যাবত আমরা করে আসছি।"
"আমাদের সরকারের সবসময় প্রচেষ্টা থাকে বাজেট ঘাটতি-কে জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখা। গত বছর আমাদের বাজেট ঘাটতি ছিল ৫.১ শতাংশ যা এই অর্থবছরে ৫.৫ শতাংশ ধরা আছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো সামাজিক খাতে সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি করা যা আমরা প্রতি অর্থবছরে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করছি।"
মন্ত্রী আরো জানান, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে চলতি অর্থবছরে সরকারের বরাদ্দ রয়েছে ১ লক্ষ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের প্রায় ১৭%। আর্থিক খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নতুন কয়েকটি আইন প্রণয়ন এবং পুরোনো কয়েকটি আইনের সংশোধনের চলমান কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা; রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার জোরদার এবং কর প্রশাসনের দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করা হবে বলে জানান তিনি।
তিনি আরো বলেন, "ভ্যাট আদায়ের জন্য আমরা ইএফডি মেশিন স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি। এযাবত ৬,৭৩২টি মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। আগামী বছরে আরো ৬০ হাজার মেশিন স্থাপন করা হবে এবং পরবর্তী ৪ বছরে ২ লক্ষ ৪০ হাজার মেশিন স্থাপিত হবে।"
সামনে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য কমলে দেশের অভ্যন্তরেও যেন তা একইভাবে কমানো যায়, তার জন্য জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের ব্যবস্থাটি আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যের সাথে সময়ে সময়ে সমন্বয় করা হবে বলে জানান তিনি।
অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, "টাকার বিনিময় হার নির্ধারণের কাজটি ধীরে ধীরে বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া (যা আমরা ইতোমধ্যে শুরু করেছি), সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা এবং সেদিকে লক্ষ্য রেখে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা; একটি দুর্যোগ ঝুঁকি অর্থায়নের পরিকল্পনা করা, যার মধ্যে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার বিষয়টিও থাকবে পরিকল্পনায়।"
এই প্রেস ব্রিফিং-এ আরো উপস্থিত ছিলেন আব্দুর রউফ তালুকদার এবং অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন।
এদিকে, ঋণের বিষয়ে জারি করা আইএমএফের একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আইএমএফের এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) এবং এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি থেকে ৩২০ কোটি ডলার এবং রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় ১৩০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার বিষয়ে কর্মকর্তা পর্যায়ে তারা একমত হয়েছেন।
আরো বলা হয়েছে, এ ঋণের উদ্দেশ্য বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা এবং অসুবিধাগ্রস্ত মানুষকে রক্ষা করে শক্তিশালী, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সবুজ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করা। ৪২ মাস ধরে বিভিন্ন কিস্তিতে এ ঋণ দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করেছে তারা।