বিনিয়োগ, রপ্তানি ও কর্মসংস্থানে ইপিজেডের রেকর্ড প্রবৃদ্ধি

বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা)-র আট রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) ২০২১-২২ অর্থবছরে বিনিয়োগ, রপ্তানি ও কর্মসংস্থান তৈরিতে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।
বেপজা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ইপিজেডগুলো গত অর্থবছরে ৪১০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ পেয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২০ দশমিক ২৬ শতাংশ বেশি।
একই সময়ে ইপিজেড থেকে রপ্তানি আয় ৩০ দশমিক ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৮.৭ বিলিয়ন ডলার হয়েছে যেখানে নতুন কর্মসংস্থানের সংখ্যা ৩৬ দশমিক ১৩ শতাংশ বেড়ে ৬৪ হাজার ১৬০টিতে দাঁড়িয়েছে।
বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল আবুল কালাম মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান কোভিড মহামারির কঠিন সময়ের মধ্যেও এই গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধির পেছনে দেশের বিনিয়োগ-বান্ধব, শ্রমবান্ধব ও পরিবেশবান্ধব কর্ম পরিবেশের প্রসারকে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
সরকারের দূরদর্শিতার ফলস্বরূপ বিনিয়োগ-বান্ধব নীতি নির্ধারণ এবং ব্যবসায়ীদের জন্য বিভিন্ন প্রণোদনার ব্যবস্থা শুধু দেশি বিনিয়োগকারীদেরই নয় বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরও আকৃষ্ট করছে উল্লেখ করে তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এসব কারণে বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে বিনিয়োগ বেড়েছে।'
ইপিজেডের সব খাতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যা করে বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, ১৯৮০ সালে ইপিজেড এর যাত্রা শুরু হয়। এই ৪২ বছরে দক্ষতা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে কর্মরত আমাদের অত্যন্ত দক্ষ টিম গড়ে উঠেছে। বিনিয়োগকারীরা দেখতে চান কীভাবে সরকারী নীতিগুলি বাস্তবায়িত হচ্ছে। বেপজার কর্মকর্তারা এই বিষয়ে খুবই আন্তরিক। বিনিয়োগকারীরা ইজ অব ডুয়িং বিজনেসের প্রেক্ষাপটে বেপজাকে আদর্শ জায়গা মনে করেন। এ কারণেই অনেকে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হচ্ছে'।
'একই সঙ্গে আমরা শ্রমবান্ধব পরিবেশ ও পরিবেশবান্ধব পরিবেশ তৈরি করেছি। শ্রমিকদের অধিকার যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয় সেজন্য আমরা মনিটরিং করছি। ইপিজেডের প্রতিষ্ঠানগুলো কমপ্লায়েন্স পলিসি মেনে চলছে। গ্রিন ফ্যাক্টরি থাকায় বিদেশি বায়াররা এখানকার পণ্য কিনতে আকৃষ্ট হচ্ছে,' বলেন তিনি।
বেপজার অধীনে এখন আটটি ইপিজেড রয়েছে। এগুলো হলো- চট্টগ্রাম ইপিজেড, ঢাকা ইপিজেড, মংলা ইপিজেড, ঈশ্বরদী ইপিজেড, কুমিল্লা ইপিজেড, উত্তরা ইপিজেড, আদমজী ইপিজেড এবং কর্ণফুলী ইপিজেড। জুন মাস পর্যন্ত আটটি ইপিজেডে চালু ছিল ৪৫৬টি শিল্প প্রতিষ্ঠান যার মধ্যে ১৪৯টি তৈরি পোশাক শিল্পের।
বিভিন্ন স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান নাইকি, রিবক, লাফুমা, এইচ অ্যান্ড এম (সুইডেন), গ্যাপ, ব্রুকস, জে সি পেনি, ওয়ালমার্ট, কেমার্ট, অসপিগ (জার্মানি), মাদার কেয়ার (ইউকে), লি, রেংলার, ডকারস, এনবিএ, টমি হিলফিগার, অ্যাডিডাস, ফ্যালকন ( ইউএসএ), এডি বাউয়ার, ঈগল, রিলেহ (ইউকে), এমিলি, ফ্রি স্পিরিল (ইউকে), মাইলস (জার্মানি), আমেরিকান ঈগল, হাই-টেক (ইউকে), ফিলিপ-মরিস (ইউকে), উইনস মোর, ডেকাথলন ইত্যাদি বাংলাদেশি ইপিজেড থেকে পণ্য কিনে থাকে।
ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের পরিচালক এবং বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক মো. মহিউদ্দিন রুবেল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ইপিজেডগুলো শিল্প-কারখানাগুলোকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে যার মধ্যে রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন ইউটিলিটি পরিষেবা, যা দ্রুত উৎপাদনের নিশ্চয়তা দেয়।'
'এছাড়া বেপজা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। এখানকার বিভিন্ন বিষয় সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে থাকে। যেকোনো সমস্যা দ্রুত সমাধান করা যায়। ফলে বিদেশিরা এখানে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হয়। এছাড়া যেহেতু কাজের পরিবেশ ভালো, ক্রেতারাও এখানকার পণ্য কিনতে বেশি আগ্রহী,' বলেন তিনি।
বিনিয়োগ
২০২১-২২ অর্থবছরে বেপজা যে ৪০৯.৮ মিলিয়ন বিনিয়োগ ডলার করেছে তা সরকারি সংস্থার ইতিহাসে এক বছরে সর্বোচ্চ। এর আগে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ ছিল ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪০৬.৩৫ মিলিয়ন ডলার।
গত বছরের মোট বিনিয়োগের মধ্যে, চট্টগ্রাম ইপিজেডে সর্বোচ্চ ৮৮.৮৬ মিলিয়ন ডলার, ঢাকা ইপিজেডে ৭১.০৭ মিলিয়ন ডলার, আদমজী ইপিজেডে ৭০.৬২ মিলিয়ন ডলার, কুমিল্লা ইপিজেডে ৬৭.৪৬ মিলিয়ন ডলার, কর্ণফুলী ইপিজেডে ৪৫.১৫ মিলিয়ন ডলার, ঈশ্বরদী ইপিজেডে ৮৭.৮ মিলিয়ন ডলার, মংলা ইপিজেডে ৮.৮ মিলিয়ন ডলার এবং উত্তরা ইপিজেডে ৫.১৮ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়।
দক্ষিণ কোরিয়া, চীন (তাইওয়ান এবং হংকং), জাপান, ভারত, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ৩৭টি দেশের বিনিয়োগকারীরা ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বেপজার অধীনে আটটি ইপিজেডে ৬,০৪০.৪৩ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।
রপ্তানি
দেশের আট ইপিজেডের অপারেশনাল এন্টারপ্রাইজগুলো থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় প্রথমবারের মতো ৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। একক অর্থবছরে ইপিজেড থেকে আগের সর্বোচ্চ রপ্তানি আয় ছিল ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭৫২৪.১১ মিলিয়ন ডলার।
তবে মহামারি পূর্ববর্তী দুই অর্থবছরে বড় বড় কার্যাদেশ বাতিলের কারণে বাণিজ্য ও ব্যবসায় গুরুতর ব্যাঘাত ঘটে। বেপজা ২০২১-২২ অর্থবছরের এই স্থবির অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে অনেকাংশেই বের হয়ে এসেছে এবং রপ্তানি আয়ে একটি নতুন মাইলফলক অর্জন করেছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে ইপিজেডগুলোর মোট রপ্তানি আয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ ২.৫৯ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে চট্টগ্রাম ইপিজেড। এরপর ঢাকা ইপিজেড ২.১ বিলিয়ন ডলার, কর্ণফুলী ইপিজেড ১.৪ বিলিয়ন ডলার, আদমজী ইপিজেড ৯৩৫.৭৬ মিলিয়ন ডলার, কুমিল্লা ইপিজেড ৮১৪.৮২ মিলিয়ন ডলার, উত্তরা ইপিজেড ৩৭৬.৬৬ মিলিয়ন ডলার, ঈশ্বরদী ইপিজেড ২০৯.০৬ মিলিয়ন ডলার এবং মংলা ইপিজেড ১৫৮.২৪ মিলিয়ন ডলার অর্জন করেছে।
২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ইপিজেড থেকে মোট রপ্তানি ৯৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে।
ইপিজেড থেকে মোট রপ্তানির ৫৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ পোশাকের চালান ছিল, যদিও দেশের মোট রপ্তানির ৮৫ শতাংশজুড়ে এ খাতটির অবদান আছে।
অন্যান্য খাত যেমন গার্মেন্টস আনুষঙ্গিক, পাদুকা এবং চামড়ার পণ্য, টেক্সটাইল, তাঁবু, ক্যাপস, প্লাস্টিক পণ্য এবং ইলেকট্রনিক্স ইপিজেডের রপ্তানি আয়ের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। অর্থাৎ, ইপিজেড বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্য উৎপাদনের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান আবুল কালাম মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান বলেন, আটটি ইপিজেডের মোট ভূমির পরিমাণ ২,৩০০ একর। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ আসে ইপিজেড থেকে।
কর্মসংস্থান
গত বছর ইপিজেডগুলোতে বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য মোট ৬৪ হাজার ১৬০টি নতুন চাকরির সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৯ হাজার ১১১টি ছিল চট্টগ্রাম ইপিজেডে। এছাড়া ঢাকা ইপিজেডে ১০ হাজার ৪৫১টি, আদমজী ইপিজেডে ৯ হাজার ৯২৪টি, কুমিল্লা ইপিজেডে ৯ হাজার ৭৯২টি কর্ণফুলী ইপিজেডে ৭ হাজার ৩১১টি, ঈশ্বরদী ইপিজেডে ৩ হাজার ২টি, উত্তরা ইপিজেডে ২ হাজার ৫৯৯টি এবং মংলা ইপিজেডে এক হাজার ৯৬২টি কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।
২০২২ সালের জুন পর্যন্ত, ইপিজেডগুলোতে মোট কর্মসংস্থান দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ দুই হাজার ৩৬৫টি।
প্রস্তাবিত বিনিয়োগ
২০২১-২২ অর্থবছরে ১৪টি ব্যবসায়িক সংস্থা দেশের আট ইপিজেডে ১৭৩.৩৪ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে, যাতে প্রায় ১৮ হাজার ৯৭০ জনের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এছাড়া, চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরীতে নির্মাণাধীন বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য ১০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেয়েছে। সংস্থাগুলো ২১৫.৬৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে, যা ৪৫ হাজার ৮৭৬টি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
নতুন তিন ইপিজেড আসছে
পটুয়াখালী, যশোর এবং গাইবান্ধাতে তিনটি ইপিজেড তৈরি করছে বেপজা।
বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান জানান, নতুন ইপিজেডগুলোতে টেকনোলজিকাল পণ্যের পাশাপাশি বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্য তৈরি করবে এমন সব ব্যবসায়িক সংস্থাগুলোকে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। এখানে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিও গড়ে তোলা হবে।
'আমরা বিনিয়োগকারীদের ওয়ান স্টপ পরিষেবা প্রদান করি। বিনিয়োগ বাড়াতে আমরা বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা), বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক অথরিটি, বাংলাদেশ ইকোনমিক জোনস অথরিটি, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করছি,' বলেন তিনি।