তেল বাণিজ্যের সুবাদে শক্তিশালী হচ্ছে চীনের ইউয়ান
ইউয়ানকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান নিয়ামক বানাতে চান চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তার সে প্রচেষ্টার পালে উত্তাল গতি আনছে বৈশ্বিক জ্বালানি বাণিজ্য। ফলত দারুণ এক সুসময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে মুদ্রাটি।
গত সপ্তাহে রাশিয়ান জায়ান্ট গ্যাজপ্রমের সাথে জ্বালানি চালান লেনদেনে ইনভয়েস পেমেন্ট চুক্তি করে চীন, এর আওতায় ডলারের বদলে রাশিয়ান রুবল ও চীনা ইউয়ানে মূল্য পরিশোধ করা হবে।
রাশিয়ার জ্বালানি তেল খাতের আরেক জায়ান্ট রসনেফট দেশটির সর্ববৃহৎ ইউয়ান-ভিত্তিক বন্ড বাজারে আনছে।
ব্লুমবার্গের সংবাদ সূত্রে জানা যায়, গত ১৩ সেপ্টেম্বর বাজারে ছাড়া বন্ডের মাধ্যমে ১০ বিলিয়ন ইউয়ান (১৪০ কোটি ডলার) সংগ্রহ করতে চায় রসনেফট।
রাশিয়ার খনিজ ও কাঁচামাল পণ্য রপ্তানিকারক অন্যান্য শীর্ষ সংস্থাও রসনেফটের মতো করে লেনদেনের উপায় গ্রহণ করছে। এমন আরও দুটি সংস্থা হলো- অ্যালুমিনিয়াম খাতের মহাকায় ইউনাইটেড কো. রুসাল ইন্টারন্যাশনাল পিজেএসসি এবং স্বর্ণখনি ব্যবসার জায়ান্ট পলিউস পিজেএসসি।
এমন খবরও মিলছে যে, রাশিয়ার তেল উৎপাদক গ্যাজপ্রম নেফট-ও ঝুঁকছে ইউয়ান বন্ডে। লৌহ আকরিক খনি কোম্পানি- মেটালোইনভেস্ট হোল্ডিং কোং- ও আছে এ তালিকায়।
রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর– এলভিরা নাবিউলিনা চলতি মাসের ১ তারিখে বলেন, কৌশলগত রিজার্ভে যোগ করতে ৭০ বিলিয়ন ইউয়ান এবং বন্ধুসুলভ অন্যান্য দেশের মুদ্রা কেনার কথা ভাবছেন তারা।
নাবিউলিনার এমন ইঙ্গিত দেওয়ার দুই সপ্তাহ আগে– আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং বার্তা আদান-প্রদানকারী সংস্থা- সুইফট জানায়, বৈশ্বিক লেনদেন ইউয়ানে করার দিক থেকে তৃতীয় বৃহত্তম হয়ে উঠেছে রাশিয়া। প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে হংকং ও ব্রিটেন।
গত জুলাইয়ে চীনের মোট অশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির ১৯.১ শতাংশ কেনা হয় রাশিয়া থেকে। জুনের পর যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। আগস্ট এবং চলতি মাসে এটি আরও বেড়েছে বলে বাণিজ্যের নানান সূত্রে ইঙ্গিত মিলছে।
চীন-রাশিয়া যত বেশি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য করবে, ততোটাই বলিষ্ঠভাবে ইউয়ানকে এসব লেনদেনের চাবিকাঠি বানানোর সুযোগ পাবেন শি জিনপিং। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তিগুলোর কেন্দ্রেই থাকবে চীনা মুদ্রা ব্যবহারের শর্ত। আর রাশিয়া তাতে সানন্দেই সায় দিচ্ছে।
রাশিয়া বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জ্বালানি পণ্য- তেল, গ্যাস, কয়লা ইত্যাদির রপ্তানিকারক। এসব বিক্রির জন্য মস্কো ইউয়ানে অর্থ নিতে শুরু করলে–রাশিয়ার সাথে বাণিজ্যকারী অনেক দেশই চীনা মুদ্রাটিকে বেছে নেবে। শি জিনপিং এভাবেই বাজিমাৎ করতে চান। ইউয়ানের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে চান।
আপাতত তিনি রাশিয়ায় সফল হচ্ছেন। ইউয়ানের যোগান বেড়েছে রাশিয়ার মুদ্রাবাজারে। মস্কো এক্সচেঞ্জে বিকিকিনি হওয়া মোট বৈদেশিক মুদ্রার মধ্যে ২৬ শতাংশই এখন ইউয়ান, এপ্রিলে যা ছিল মাত্র ৬ শতাংশ।
ইউয়ান-রুবল বিনিময় বাণিজ্য বৃদ্ধি শি জিনপিং দেশের মুদ্রাকে আন্তর্জাতিকীকরণের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যেরই সহায়ক। এতে বিশ্বের আরেক শীর্ষ জ্বালানি রপ্তানিকারক সৌদি আরবও চীনের কথামতো ইউয়ানে তেলের দাম নিতে উৎসাহিত হবে। এর আগে ভেনিজুয়েলাও ডলার বর্জন করে ইউয়ানে তেল বাণিজ্যের ঘোষণা দিয়েছে।
চলতি সপ্তাহে উজবেকিস্তানে শি জিনপিং ও ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে, সেখানে বড় এজেন্ডা হিসেবে থাকবে ইউয়ান-রুবল বাণিজ্য।
পশ্চিমাদের বিরোধীতায় একাট্টা হয়ে ওঠা শক্তিধর রাষ্ট্র দুটির মিত্রতা তাতে আরও জোরালো হবে বলেই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
এই মুহূর্তে পুতিনের দরকার বলিষ্ঠ সহযোগী। ইউক্রেনে আগ্রাসন নিয়ে বৈশ্বিক স্তরে তিনি এখন অনেকটাই একা হয়ে পড়েছেন। এই সময়ে চীনের বন্ধুত্ব তার একান্তই দরকার।
দরকার শি জিনপিংয়েরও রয়েছে। গত ৩০ বছরের মধ্যে বর্তমানেই সবচেয়ে ধীর গতিতে হচ্ছে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। হংকং ও তাইওয়ান ইস্যুতেও তার সঙ্গে বেড়েছে পশ্চিমাদের দূরত্ব।
এই সময়ে রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তায় জ্বালানি ও কাঁচামাল কেনার সুবিধা চীনের জন্য অনুকূুল–উপলদ্ধি করছেন শি।
গত আগস্টে দেখা যায় যার প্রতিফলন। এসময় মার্কিন ডলারের বিচারে চীন ও রাশিয়ার মধ্যেকার আমদানি-রপ্তানির চালান বেড়েছে ২৬.৫ শতাংশ (গত বছরের একই সময়ের তুলনায়)। জুলাইয়ে যা বেড়েছিল ২২.২ শতাংশ। আগস্টে রাশিয়া থেকে চীনের আমদানি বেড়েছে ৫৯ শতাংশ, জুলাইয়ে যা ছিল ৪৯ শতাংশ।
তবে দীর্ঘমেয়াদে ইউয়ানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রধান মুদ্রা হতে হলে দরকার হবে সৌদি আরবের। মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি ইউয়ানকে গ্রহণ করলে রাতারাতি জ্বালানি বাণিজ্যের নিয়ামকে পরিণত হবে চীনের মুদ্রা।
সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী রাষ্ট্র। রিয়াদ যদি চীনা মুদ্রাকে গ্রহণ করে তাহলে এই অঞ্চলের জ্বালানি রপ্তানিকারক অন্য দেশগুলিও সে পদাঙ্ক অনুসরণ করবে।
হনলুলুর চামিনাডে ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ ক্রিস্টোফার ম্যাকনিলি বলেন, 'আন্তর্জাতিক মুদ্রা লেনদেনে বৈচিত্র্য আনলে– রিয়াদ ও বেইজিং উভয়েই লাভবান হবে'।
সৌদি আরবের সঙ্গে ইউয়ান নিয়ে তাই চীনের আলোচনা ও উদ্যোগ চলছে।
এর আগে গত মার্চে বৈশ্বিক গণমাধ্যমে গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হয় একটি সংবাদ। সেখানে বলা হয়, সৌদি আরব থেকে কিছু তেলের চালান ইউয়ানে কিনতে দেশটির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে আলোচনা করছে বেইজিং।
ডলারের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল অর্থনীতি- চীন ও সৌদি আরবের পক্ষে এই রুপান্তর কোনো সহজ পদক্ষেপ নয়। কিন্তু, সাম্প্রতিক ঘটনাবলী ডলারের প্রতিযোগী বিকল্প মুদ্রা নিয়ে আগ্রহকে জোরালো করছে, যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব ওয়াশিংটন এখনও অনুধাবন করতে পারেনি।
মার্কিন মুদ্রার ওপর আস্থা হারানোর অন্যতম কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের ৩০ লাখ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়া জাতীয় দেনা। তারমধ্যে দেশটিতে চলছে ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। ফেডারেল রিজার্ভ সুদহার বাড়ানোয়, অন্যান্য মুদ্রার বিপরীতে বেড়েছে ডলারের বিনিময় দর। আবার, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু করায় মস্কোর রিজার্ভের একটি অংশ মার্কিন সরকারের বাজেয়াপ্ত করার ঘটনাতেও উদ্বেগ বেড়েছে মস্কো ও রিয়াদের।
আন্তর্জাতিক একটি বিনিয়োগ গবেষণা সংস্থা– গ্যাভেকাল রিসার্চের বিশেষজ্ঞ লুইস গেভ বলেন, (ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্তে) এই ইঙ্গিতই মিলছে বিশ্ব অর্থনীতিকে এখন হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের যুগ শুরু হয়েছে।
আর ইউয়ানকে সে হাতিয়ারের আঘাত মোকাবিলায় ঢাল বানাতেও চাইছে বেইজিং।
- লেখক: ব্লুমবার্গের টোকিও-ভিত্তিক কলামিস্ট উইলিয়াম পেসেক। তিনি এশিয়া মহাদেশের সমসাময়িক রাজনীতি, অর্থনীতি, বাজার ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত লেখালেখি করেন বিশ্বের প্রভাবশালী অনেক গণমাধ্যমে।
- সূত্র: এশিয়া টাইমস