রপ্তানিকারকরা কাঁচামাল সংকটে
রপ্তানি আয়ের বিপরীতে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে নেওয়া পূর্বের ঋণ পরিশোধ না হওয়া এবং ডলার সংকটের যুক্তিতে কিছু ব্যাংকের এলসি (ঋণপত্র) খোলার আপত্তি- কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত করছে। এতে নির্ধারিত সময়ে চালান পাঠানো সম্ভব হবে না বলে আশঙ্কা করছে রপ্তানিমুখী ব্যবসাগুলি। এমনটাই জানিয়েছেন শিল্প-সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলার শক্তিশালী হতে থাকায় এবং বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বাড়তে থাকায় ইডিএফ থেকে ঋণগ্রহণকেও অপর্যাপ্ত বলে মনে করছেন অনেক রপ্তানিকারক। অন্তত এক ডজন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী নেতা এমনটাই জানান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে।
এতে সময়মতো বিদেশি ক্রেতার কাছে পণ্য ডেলিভারি দেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে বলে তারা উল্লেখ করেন।
বৈশ্বিক অর্থনীতির বর্তমান সংকটকালে বিদেশি অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের তাদের অর্ডার করা চালান দেরি করে পাঠানোর অনুরোধ করছে। তারমধ্যে কাঁচামালের আসন্ন সংকট পোশাক শিল্পের জন্য মারাত্মক আঘাত হয়ে উঠবে বলেছেন বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ'র সভাপতি ফারুক হাসান।
তিনি বলেন, 'শিপমেন্টের ডেডলাইন মিস করলে বায়াররা হয় অর্ডার বাতিল করবে, নাহয় ডিসকাউন্ট (মূল্যছাড়) চাইবে'।
স্থানীয় বাজার-নির্ভর ব্যবস্থাগুলিও সমস্যার কবলে। এন জেড টেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালেউধ জামান জিতু টিবিএসকে জানান, যেহেতু তারা দেশীয় মুদ্রায় এলসি মূল্য পরিশোধ করেন–এজন্য অনেক ব্যাংকই তাদের এলসি হ্যান্ডেল করতে চাইছে না। এতে তারাও নিকট ভবিষ্যতে কাঁচামাল সংকটে পড়ার ভয়ে রয়েছেন।
উৎপাদন কাজ অব্যাহত রাখতে টেক্সটাইল মিলগুলির কাছে অন্তত চার-পাঁচ মাসের কাঁচামাল মজুদ থাকতে হয়। এর মাধ্যমে তারা পোশাক প্রস্তুতকারকদের চাহিদামতো সরবরাহ করতে পারেন। বিষয়টি জানিয়ে জিতু বলেন, 'এজন্য আমাদের প্রতিমাসে এলসি খুলতে হয়। আমরা চাহিদামতো কাঁচামাল সংগ্রহ করতে না পারলে, পোশাক প্রস্তুতকারকদের কাছে সুতা ও ফেব্রিক সরবরাহ করতে পারব না; এতে তাদের শিপমেন্টে দেরি হবে এবং ব্যবসাতে অনেক ক্ষতি হবে'।
ইডিএফ ঋণের আওতায় রপ্তানি আয় নগদায়ন বিলম্বিত হওয়ায় এবং ইউপিএস ব্যবস্থার কারণে অনেক ব্যাংকই এলসি খুলতে চাইছে না বলে এরমধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)।
বিটিএমএ'র অতিরিক্ত পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী (ভারপ্রাপ্ত) মনসুর আহমেদ বলেন, ডলার সংকটের কথা বলে অনেক ব্যাংক তুলা ও আঁশের মতো অত্যাবশ্যক কাঁচামাল আমদানির এলসি খুলতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। নোমান গ্রুপসহ তাদের সংগঠনের কিছু সদস্য ইতোমধ্যেই বিটিএমএ'কে এবিষয়ে জানিয়েছে। অথচ এই কাঁচামালগুলি রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাগুলোয় সরবরাহের জন্য একান্ত জরুরি।
এবিষয়ে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন বলেও জানান তিনি।
নাম না প্রকাশের শর্তে নোমান গ্রুপের একজন কর্মকর্তা জানান, 'নানান অজুহাতে তাদের এলসি খুলতে আপত্তি জানাচ্ছে একটি শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক। এদিকে আমাদের মজুতে থাকা তুলা দিয়ে আর মাত্র তিন মাস উৎপাদন চালাতে পারব'।
বিকেএমইএ'র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম টিবিএসকে জানান, তাদের কাছে সন্তোষজনক সংখ্যায় কার্যাদেশ থাকলেও, এলসি খুলতে পারছেন না। 'দরকারি কাঁচামাল সময়মতো সংগ্রহ করতে না পারলে আমরা বায়ারদের হারাব'- বলেন তিনি।
এবিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ব্যাংককে এলসি খুলতে জোর করে বাধ্য করতে পারে না। এটি পুরোপুরি গ্রাহক ও ব্যাংক সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে।
'তবে কোনো ব্যাংক ইচ্ছে করে এলসি খুলতে বিলম্ব করছে–সুনির্দিষ্ট এমন অভিযোগ পাওয়া গেলে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব'।
এদিকে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পণ্যের দাম কমানোর দাবি করছে কিছু বিদেশি ক্রেতা, এনিয়ে রপ্তানিকারকরা আরেক সমস্যার মধ্যে পড়েছেন বলে জানান শাশা ডেনিম এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ।
তিনি বলেন, 'এজন্যেই আমাদের মধ্যে কেউ কেউ টাকা অবমূল্যায়িত হওয়ার সুফল পাচ্ছে না'। এছাড়া, তুলা উৎপাদনকারী বিশ্বের প্রধান কিছু অঞ্চলে তীব্র খরা এবং পাকিস্তানে বন্যার কারণে এই কাঁচামালের দাম বিশ্ববাজারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
গত এক বছরেই দ্বিগুণ হয়েছে তুলার দাম। মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক ফিউচার্স বাজারে প্রতি পাউন্ড ১.২ থেকে ১.৬ ডলার ছিল তুলার দর। কিন্তু, বিটিএমএ'র সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় বাজারে কেজিপ্রতি ৪.৫০ ডলারে সুতা বিক্রি হচ্ছে।
চলমান জ্বালানি সংকটও প্রস্তুতকারক শিল্পের সামনে আশার আলো দেখাচ্ছে না। গ্যাস সংকটে ভুগছে গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের টেক্সটাইল ও পোশাক শিল্পগুলি। কিছু কিছু টেক্সটাইল কারখানায় উৎপাদন স্থবির হয়ে পড়েছে।
ভার্টিক্যাল উভেন টেক্সটাইল উৎপাদক সালেউধ জামান খান জিতু জানান, উৎপাদন বন্ধ থাকলেও মাসে তার প্রতিষ্ঠানের পরিচালন খরচ দাঁড়ায় অন্তত ৩০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, গুরুতর গ্যাস সংকটের কারণে তার মাসিক আয় ৬ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের কর্মকর্তারা জানান, জাতীয় গ্রিডে কম সরবরাহ যোগ হওয়াই গ্যাস সংকটের প্রধান কারণ।
তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জি. মো. হারুনুর রশিদ টিবিএসকে জানান, তারা যদি জাতীয় গ্রিড থেকে উচ্চ মাত্রায় গ্যাস সরবরাহ পান–কেবল তাহলেই পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। এছাড়া, বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস ব্যবহার কমলেও সংকট কাটবে, যা শুধুমাত্র শীতকাল আসলেই সম্ভব।
বর্তমানে ২৮.৭৪ লাখ গ্রাহককে সরবরাহে তিতাস গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ১,৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু, দেশের সর্ববৃহৎ গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানিটি বর্তমানে সরবরাহকারী কোম্পানির কাছ থেকে পাচ্ছে ১,৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
গত বছরের একই সময়ে তিতাস গ্যাস ১,৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ পেতো, তখন আমদানি করা এলএনজি উৎস থেকে যোগ হতো ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
কিন্তু, বর্তমানে মাত্র ৪৮০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে। ফলে দেশে গ্যাসের সার্বিক সরবরাহ নেমে এসেছে ২,৭৯২ মিলিয়ন ঘনফুটে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে যা ছিল ৩,০১১ মিলিয়ন ঘনফুট।
তার উপর আবার, চলমান লোডশেডিং উৎপাদন শিল্পকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। ইনডেট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আল শাহরিয়ার আহমেদ জানান, তার প্রতিষ্ঠানের মাসিক ডিজেল জেনারেটর চালানোর খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ টাকায়, অথচ ২০২১ সালের পুরো সময়ে এই খরচ হয়েছিল ৩০ লাখ টাকা।