ফার্ম নিবন্ধন সহজ করতে বিডা'র নতুন প্রকল্পের পরিকল্পনা
ব্যবসা শুরু করতে ফার্ম রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি সহজ করে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য নতুন কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)।
বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ক্লাইমেট ইমপ্রুভমেন্ট (বিআইসিআই) নামের এই কর্মসূচির লক্ষ্য বিনিয়োগ এবং ফার্ম রেজিস্ট্রেশন বার্ষিক অন্তত ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো।
ব্যবসার পরিবেশ সহজতর করতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে এতে বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ সাতটি বিষয় সহজ করার লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সহায়তায় কর্মসূচিটি চূড়ান্ত করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে বিডা। বিআইসিআই ফ্রেমওয়ার্ক অনুযায়ী, আগামী ৫০ সপ্তাহে ৫০টি সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হবে এবং তিন বছরে ১০০ সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন সম্পন্ন করবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালগুলো।
মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে ডুয়িং বিজনেস রিফর্মের ন্যাশনাল কমিটি ফর মনিটরিং দ্য ইমপ্লিমেন্টেশন সম্প্রতি দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় ও বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য সংস্কার বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় নতুন কর্মসূচিটি এসেছে।
বিডা কর্মকর্তাদের মতে, নতুন প্রোগ্রামটি বিশ্বব্যাংকের ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস প্রোগ্রামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যার অধীনে ইতিমধ্যে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং কিছু প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট সূচক ও বাংলাদেশের স্থানীয় সূচক বিবেচনা করে সাতটি পিলার চিহ্নিত করেছে বিআইসিআই ফ্রেমওয়ার্ক।
এর মধ্যে রয়েছে- বিজনেস এন্ট্রি, এক্সিট এন্ড টেকনোলজি এডাপশন; ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইনফ্রাস্ট্রাকচার এন্ড লজিস্টিকস; ক্রসবর্ডার ট্রেড এন্ড বিজনেস; কমার্শিয়াল ডিসপুট রেজুলেশন এন্ড লেঢার রেগুলেশনস; ট্যাক্স রিজিম; ফাইন্যান্সিয়াল এন্ড নন-ফাইন্যান্সিয়াল ইনসেনটিভস এবং এক্সসেস টু ফাইন্যান্স।
'ফ্রেমওয়ার্ক অন প্রোপজড বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ক্লাইমেট ইম্প্রুভমেন্ট (বিআইসিআই) শীর্ষক সাম্প্রতিক এক ওয়ার্কশপে বলা হয়েছে, এ কর্মসূচির আওতায় তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সারাদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে সার্ভে পরিচালনা করে সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান করা হবে।
এই কর্মসূচির আওতায় প্রতিবছরই কুইক সার্ভে করে মাঠ পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধান করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
কর্মসূচিটি চূড়ান্ত করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর আগে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর মতামতও নিয়েছে বিডা। সেখানে ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়িক পরিবেশ সংস্কার নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন।
ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে বলেছেন, সেবা পেতে এখনও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের ঘুষ দিতে হচ্ছে। এছাড়া, উচ্চ কর হারকে বাংলাদেশের ব্যবসার প্রতিবন্ধকতা বলে উল্লেখ করেন তারা। বিডা প্রতিষ্ঠিত ওয়ান স্টপ সার্ভিস থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা মিলছে না এবং ব্যবসা শুরুর বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইনগত প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি দীর্ঘসূত্রিতা বিদ্যমান, যা ব্যবসায়ীদের হতাশ করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিন বছর ধরে ইজ অব ডুয়িং বিজনেস (ইওডিবি) সূচক প্রকাশ করছে না বিশ্বব্যাংক। সর্বশেষ ২০১৯ সালে প্রকাশিত ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে বিশ্বের ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৮তম।
তিন বছরে বাংলাদেশের ব্যবসার পরিবেশ কতোটুকু ভালো হয়েছে, ব্যবসায়ীদের সমস্যা কতোটা বেড়েছে- এসব বিষয়ে সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য নেই।
তাছাড়া, সরকার বিভিন্ন সময় ব্যবসা সহজীকরণের জন্য যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, মাঠ পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা তা থেকে আদৌ কোন সুফল পাচ্ছে কি-না, তাও জানা নেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।
ভিশন ২০৪১ এর সঙ্গে বিআইসিআই সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বিআইসিআই-এর মতে, প্রস্তাবিত কুইক ও মিনি সার্ভেগুলো প্রতি বছর ৩০ এপ্রিলের মধ্যে পরিচালিত হবে। একই সময়ে, পূর্ববর্তী ১২ মাসের বিদ্যমান বিশ্লেষণাত্মক প্রতিবেদন ও বেসরকারি খাতের ইনপুট নিয়ে নিড-বেজস সংস্কারের কাজে ব্যবহার করা হবে।
সমীক্ষার পূর্বনির্ধারিত টেমপ্লেট ব্যবহার করে ইনপুট সংগ্রহ করা হবে।
বিডার বিআইসিআই রিফর্ম ইউনিট বেসরকারি খাতের সঙ্গে আলোচনা ও সেগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিষয়গু্লো চূড়ান্ত করবে।
নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব হবে বাস্তবায়নকারী সংস্থার।
প্রতিটি পিলারের জন্য নির্দিষ্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ সংস্কার বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের জন্য মাসিক সভা আহ্বান করবে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টার নেতৃত্বে জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে মনিটরিং কমিটিগুলোকে অবহিত করতে একটি টাস্কফোর্স দ্বি-মাসিক বৈঠকের আয়োজন করবে।
বিআইসিআই কর্মসূচি নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বেসরকারিখাতের প্রতিনিধিদের নিয়ে গত জুনে একটি ওয়ার্কশপ করে বিডা। সেখানে সংস্থাটির সদ্য বিদায়ী নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, গত তিন বছরে বিডার ওয়ান স্টপ সার্ভিস এ দাখিল হওয়া ৮৪,০০০ পরিষেবার আবেদনের মধ্যে মাত্র ১৫৮টি অন্যান্য সংস্থার সেবার জন্য আবেদন। বিডার ওএসএস পোর্টালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্সের জন্য একটি আবেদনও জমা পড়েনি।
'ওএসএস বাস্তবায়নের বিষয়টি তদারকির জন্য অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে ওয়ান স্টপ সার্ভিস নিশ্চিতকরণ কমিটি গঠিত হওয়ার পর বিডা গত আট মাস ধরে বার বার প্রচেষ্টা নিলেও ওই কমিটির একটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়নি', বলেন সিরাজুল ইসলাম।
বিডা'র পরিচালক (ইনভেস্টমেন্ট এনভায়রনমেন্ট সার্ভিসেস) জীবন কৃষ্ণ সাহা রায় বলেন, বিশ্বব্যাংকের ইজ অব ডুয়িং কর্মসূচিতে শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রামের ব্যবসা সহজীকরণের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতো। প্রস্তাবিত বিআইসিআই কর্মসূচি সমগ্র বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নের জন্য বাস্তবায়ন করা হবে।
'সংস্কার কার্যক্রমগুলো দেশি-বিদেশি ব্যবসা পরিবেশ সংক্রান্ত বিভিন্ন সূচকের আলোকে এবং সরকারি-বেসরকারিখাতের সকল অংশীজনের মতামত পর্যালোচনা করে চিহ্নিত করা হবে এবং কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সকল পর্যায়ে প্রয়োজনে অভ্যন্তরীণ ও নিরপেক্ষ বা তৃতীয় পক্ষের দ্বারা সমীক্ষা পরিচালনা করা হবে'- জানান তিনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ৬টি পিলারের অধীনে ৯৭টি সংস্কার চিহ্নিত করেছে বিডা। বিশ্বব্যাংকের ইজ অব ডুয়িং বিজনেস কর্মসূচির আওতায় ইতোমধ্যে ৪৬টি সংস্কার বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং ২৯টি সংস্কার প্রস্তাবনা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।
কর্মশালায় অংশ নিয়ে জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো)-এর বাংলাদেশ কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ইউজি আন্দো বলেন, বিআইসিআই এর উচিত হবে ব্যবসা শুরু করার প্রক্রিয়া সহজ করার উপর গুরুত্ব দেওয়া।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে শাখা বা যোগাযোগ অফিস স্থাপন করতে প্রায় ৬ মাস সময় লাগে, এতে বিনিয়োগকারীরা দূর্বল হয়ে পড়ে। দ্রুততম সময়ে শাখা অফিস স্থাপন বর্তমানে জাপানি বিনিযোগকারীদের একটি বিশেষ চাহিদা। সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে অবৈধ অর্থ গ্রহণ বন্ধ করতে সকল লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন কার্যক্রম অনলাইন করার পরামর্শ দেন জেট্রো কর্মকর্তা।
কেপিএমজি বাংলাদেশ এর সিনিয়র পার্টনার আদিব এইচ খান বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশের কর ব্যবস্থা ব্যাখ্যা করা কঠিন। কারণ এর ইফেক্টিভ ট্যাক্স রেট করপোরেট করের চেয়ে অনেক বেশি। কারণ, মৌলিক কর হারের পাশাপাশি টার্নওভার ট্যাক্স এবং রিপোর্টিং ট্যাক্স ইত্যাদি আরোপ করা হয়।
তিনি বলেন, যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসিঅ্যান্ডএফ) কর্তৃক স্থানীয় ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বিদেশি পুঁজির ইনওয়ার্ড রেমিটেন্স যাচাই করতে ৮-১০ দিন সময় লেগে যায়। ফলে কোম্পানি গঠনের সময় বেড়ে যায়। তিনি এক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা কমানোর সুপারিশ করেন।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) এর সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, বেশিরভাগ ব্যবসায়িক লাইসেন্স ১ বছরের জন্য দেওয়া হয়, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। তিনি ৫ বছর মেয়াদী ব্যবসায়িক লাইসেন্স দেওয়ার প্রস্তাব করেন।
সাইফুল ইসলাম বলেন, এলডিসি গ্রাজুয়েশনের আগে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হলে লিড টাইম কমাতে হবে। এজন্য বন্দরের বর্তমান অদক্ষতা একটি বড় বাধা। তিনি আরও দক্ষ পোর্ট হ্যান্ডলারদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতামুলক আন্তর্জাতিক বিডিংয়ের সুপারিশ করেন।
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফআইসিসিআই)-এর প্রেসিডেন্ট এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাসের এজাজ বিজয় বলেন, বিনিয়োগ উদ্যোগ বাস্তবায়ন বা ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে ১০টি উল্লেখযোগ্য প্রসেস রিলেটেড চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করার জন্য জরিপ পরিচালনা জরুরি। জরিপের ফলাফল অনুযায়ী প্রক্রিয়াগুলো সংস্কারের পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করেন তিনি।
'বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংস্কারের ইতিবাচক প্রভাব বেসরকারি খাত বাস্তবে অনুভব করতে পারছে না'- উল্লেখ করে সংস্কারের প্রকৃত প্রভাব যাচাই করার জন্য সমীক্ষা পরিচালনার প্রস্তাব করেন নাসের এজাজ।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহীন বলেন, 'বন্ড লাইসেন্স প্রদানের জন্য অনেক ক্ষেত্রে স্পিড মানি দাবি করা হয়ে থাকে।'
বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) এর সাবেক চেয়ারম্যান এবং এ কে খান কো. লিমিটেড এর ডিরেক্টর আবুল কাসেম খান বলেন, বাংলাদেশে ব্যবসায়িক পরিবেশ সংস্কার আশাব্যাঞ্জক নয়। বাংলাদেশের সমতুল্য প্রতিযোগী দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বলে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। প্রস্তাবিত বিআইসিআইতে বেসরকারিখাতের অংশগ্রহণ সম্মিলিত দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে ট্রেড লাইসেন্সের জন্য বাণিজ্যিক ঠিকানা দেওয়া বাধ্যতামুলক। ফলে অনেক আবেদনকারীই ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করেন। কারণ, নতুন বিনিয়োগকারীদের পক্ষে ব্যবসার শুরুতেই বাণিজ্যিক ঠিকানার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়ে উঠে না। এ কারণে তিনি স্মার্ট পলিসি এবং স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব দেন।