চাল সংগ্রহে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলেও সরকারিভাবে ধান সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকেরও কম
চাল সংগ্রহে লক্ষ্যমাত্রার ৯৭ শতাংশ পূরণ হলেও ধান সংগ্রহে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও পূরণ করতে পারেনি সরকার। প্রাকৃতিক দুর্যোগে কম উৎপাদন, ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন, আর্দ্রতার সমস্যা এবং স্থানীয় বাজারে দাম বেশি হওয়ায় সরকারের গুদামে ধান কম বিক্রি করেছে কৃষক।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত বোরো সংগ্রহ মৌসুমে সরকার ৬.৫০ লাখ টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২.৬২ লাখ টন ধান সংগ্রহ করেছে। যা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৫৯.৬১ শতাংশ কম।
বিভিন্ন জেলার কৃষক ও খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকার এবার বোরো মৌসুমে সারাদেশ থেকে ১,০৮০ টাকা মণ হিসেবে ধান কিনেছে। কিন্তু সরকারি সংগ্রহ কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু হওয়ার আগেই খোলাবাজারে দাম এর কাছাকাছি উঠে এবং কিছুদিন পরই এর চেয়ে বেশি দাম হয়ে যায়। যে কারণে কৃষকরা সরকারের কাছে ধান বিক্রিতে খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি। এছাড়া কোন কোন অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ধান সংগ্রহ কম হয়েছে।
তবে চুক্তি করে চাল না দিলে মিলগুলোর লাইসেন্স স্থগিত, জামানত বাজেয়াপ্তের মত শাস্তির আওতায় পড়তে হয় বলে বেশিরভাগ মিলাররাই সরকারের কাছে চাল বিক্রি করে। যে কারণে ধানের সংগ্রহে পিছিয়ে থাকলেও চালের সংগ্রহ ভালো হয়েছে।
এছাড়া গত বছরের তুলনায় এবারে সরকারের কাছে খাদ্যশস্যের মজুদ অনেক বেশি থাকায় ধানের সংগ্রহ পিছিয়ে থাকায় সরকার খুব বেশি উদ্বিগ্ন নয় বলেও জানা গেছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. শাখাওয়াত হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'ধান সংগ্রহের উদ্দেশ্যই থাকে কৃষক যাতে ভালো দাম পায়। এই উদ্দেশ্যটা এবার ভালোভাবে পূরণ হয়েছে। চাল সংগ্রহ ভালো হওয়ায় আমাদের স্টকও কয়েক বছরের মধ্যে ভালো।'
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারও জানান, এবার কৃষক ধানের ভালো দাম পেয়েছে। ধান কেনার মূল লক্ষ্যই থাকে একটা প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করা, যাতে কৃষক ন্যায্যমূল্যে ধান বিক্রি করতে পারে।'
ধানের সংগ্রহ কম হলেও এবারে ভালো হয়েছে চালের সংগ্রহ। ১১.৫০ লাখ টন সিদ্ধ ও আতপ চাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১১.১৬ লাখ টন চাল সংগ্রহ করেছে।
গত ২৮ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে ৩১ আগস্টে এই সংগ্রহ কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এবারে প্রতি কেজি বোরো ধান ২৭ টাকা, সিদ্ধ চাল ৪০ টাকা এবং আতপ চাল ৩৯ টাকায় কিনেছে সরকার।
জানা গেছে, চালের সংগ্রহ ভালো হওয়ার কারণে এবারে সরকারের স্টকও ভালো অবস্থায় আছে। বর্তমানে সরকারের কাছে ১৮.২৮ লাখ মেট্রিক টন চাল ও ১.৪০ লাখ মেট্রিক টন গম সহ মোট ১৯.৬৮ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে।
সারাদেশে ধান ও চাল সংগ্রহের বেশকিছু চিত্র পাওয়া গেছে বগুড়া, নওগাঁ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, যশোর, নেত্রকোনা সহ বিভিন্ন জেলা থেকে টিবিএসের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য থেকে।
জানা গেছে, বগুড়ায় এবার লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩১ শতাংশ ধান সংগ্রহ হয়েছে। তবে চাল সংগ্রহ হয়েছে প্রায় ৮৭ শতাংশ।
বগুড়া খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের তথ্য বলছে, সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে খোলাবাজারে ধানের দাম বেশি হওয়ার কারণে কৃষকের আগ্রহ কম ছিল ধান বিক্রিতে। বগুড়ায় এবার ১২ উপজেলায় ৬১,৭৩৫ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৫৩,৪৯৩ মেট্রিক টন সংগ্রহ হয়েছে। তবে ২৫,৩৪১ হাজার টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মাত্র ৭,৬৩১ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ হয়েছে।
বগুড়ার খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ আশ্রাফুজ্জামান বলেন, বোরো মৌসুমে সরকার ধান কিনেছে ১,০৮০ টাকা মণ হিসেবে। কিন্তু খোলাবাজারেই এবার ধানের দাম এর চেয়ে বেশি ছিল। এই কারণে সাধারণ কৃষকদের মধ্যে সরকারি গুদামে ধান দেওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা ছিল।
তিনি বলেন, 'প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এবার এই অঞ্চলে কিছু ধান নষ্ট হয়ে গেছে। এই কারণে কৃষকরা গুদামে ধান দিতে পারেনি।'
শস্য ভান্ডার হিসেবে পরিচিত উত্তরের জেলা নওগাঁ। গত বোরো মৌসুমে ধান উঠার আগে ঝড় ও বন্যার কারণে উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে বাজারে ধানের দাম বেড়ে যায় এবং সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি (১১০০ টাকায়) দামে খোলাবাজারেই ধান বিক্রি হয়।
যে কারণে কৃষক আর সরকারের কাছে ধান বিক্রিতে খুব বেশি আগ্রহ পায়নি। সবমিলিয়ে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৪ শতাংশ অর্জিত হয়েছে এই জেলায়। এই জেলার ১১টি উপজেলার ৪টি থেকে কোন ধানই সংগ্রহ করতে পারেনি।
বদলগাছি উপজেলার কোমারপুর গ্রামের কৃষক রেজাউল ইসলাম ও মহাদেবপুর উপজেলার মোহরপুর গ্রামের কৃষক জামাল হোসেন বলেন, গত ইরি-বোরো মৌসুমে ফসলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রতি বিঘাতে ধানের ফলন পাওয়া যায় ২০ মণের কাছাকাছি। ধানের উৎপাদন কম হওয়ায় বাজারও ছিল চড়া। মৌসুমের শুরুতে ধানের দাম ১১০০-১২০০ টাকা। তারপর ১৫-২০ দিন পর ১৩০০-১৪৫০ টাকা বিক্রি হয়। এখন পুরনো ধানের দাম কাটারি ও মিনিকেট ১৫০০-১৬০০ টাকা এবং পারিজা ১১০০ টাকা মণ। এ কারণে গুদামে ধান দেওয়া হয়নি।
জানা গেছে, নওগাঁয় চিকন বা সরু জাতের ধানের আবাদ বেশি হয়। অন্যান্য উপজেলায় মোটা ধানের আবাদ বেশি হওয়ায় শুরুতে কিছু ধান সংগ্রহ করতে পেরেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে মোটা ধানের দামও বেড়ে যায়।
নওগাঁ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আলমগীর কবীর বলেন, প্রথমদিকে স্থানীয় বাজারে ধানের দাম কম থাকলেও পরবর্তীতে তা বাড়তে থাকে। যে সময়ে বাজারে ধানের দাম কম ছিল তখন কিছু কৃষক গুদামে ধান দিয়েছেন। স্থানীয় বাজারে ধানের দাম বেশি হওয়ায় সংগ্রহ অভিযান সফল করা সম্ভব হয়নি। কৃষকরা স্থানীয় বাজারে বেশি দামে ধান বিক্রি করেছে।
একই চিত্র দেখা গেছে যশোর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নেত্রকোনায়। জানা গেছে, কৃষকদেরকে পরিবহন করে খাদ্য গুদামে ধান নিয়ে যেতে হয়। সেখানে যদি ধানের আর্দ্রতা নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি থাকে তাহলে ধান নেয়না সরকার। অন্যদিকে ধান বিক্রির পর টাকা দেওয়া হয় কৃষকের একাউন্টের মাধ্যমে। এ ধরনের ঝামেলাগুলো থেকে দূরে থাকতেই অনেক কৃষক সরকারকে ধান দেয় না।
নেত্রকোনার জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মিজানুর রহমান বলেন, খাদ্য গুদামে শুকনো ও নির্দিষ্ট আর্দ্রতার ধান কেনা হয়। কিন্তু বন্যাজনিত কারণে এখানকার চাষীদের ধান ততোটা মানসম্মত হয়নি। বেশিরভাগ ধানের রং কালো হয়ে গেছে। এ কারণে চাষীরাও ধান নিয়ে গুদামে আসেনি।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন টিবিএসের বগুড়া প্রতিনিধি খোরশেদ আলম, নেত্রকোনা প্রতিনিধি সঞ্জয় সরকার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি আজিজুল সঞ্চয়, যশোর প্রতিনিধি মনোয়ার আহমেদ, নওগাঁ প্রতিনিধি আব্বাস আলী প্রমুখ)