স্থানীয় ব্যাংকের ঋণ না পেয়ে, বিদেশি ঋণে ব্যবসা ঘুরে দাঁড় করাতে চায় সাদ মুসা গ্রুপ
১৯৮০-এর দশকে আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে ব্যবসা শুরু। কিন্তু চট্টগ্রামভিত্তিক সাদ মুসা গ্রুপ সাফল্যের দেখা পায় ১৯৯০-এর দশকে টেক্সটাইল ব্যবসা শুরুর পর। সময়ের সাথে সাথে টেক্সটাইলের বিভিন্ন উপখাতে দৃঢ়ভাবে ব্যবসা সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে।
২০১০ সাল পর্যন্ত তাদের ব্যবসা ঠিকঠাকই চলছিল—কিন্তু এ সময়ে তারা একটি নতুন প্রকল্পে আগ্রাসী বিনিয়োগ করে ফেলে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয় ইউটিলিটি সংযোগ না পাওয়ার কারণে।
এই খারাপ সময় পাড়ি দিয়ে ব্যবসায় বৈচিত্র্য আনয়নের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরতে বিপুল বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে শিল্প গোষ্ঠীটি। চলমান টেক্সটাইল ব্যবসার পাশাপাশি ইস্পাত, সিমেন্ট, কৃষি, অবকাশ কেন্দ্র ও আবাসনের মতো খাতেও নতুন করে বিনিয়োগের কথা ভাবছে।
গ্রুপটি প্রায় ৩৩৪ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের লক্ষ্য নিয়েছে, যার সিংহভাগ অর্থায়ন আসবে বিদেশি ঋণের মাধ্যমে। স্থাপন করছে সুলতানা হাবিবা ফ্যাব্রিক্স মিল, যাতে থাকবে আটটি ইউনিট। এ কারখানায় কটন ইয়ার্ন স্পিনিং, ব্লেন্ডেড ইয়ার্ন স্পিনিং, ওয়েভিং, সার্কুলার নিটিং, আরএমজি ডাইং, প্রিন্টিং অ্যান্ড ফিনিশিং, হোম টেক্সটাইল ডাইং এবং ইয়ার্ন ডাইং- এর কার্যক্রম চলবে বলে জানান কোম্পানিটির কর্মকর্তারা।
এই মিলটি সম্প্রসারণ ছাড়াও সাদ মুসা ডেনিম এবং সাদ মুসা টেরি টাওয়েলস মিলে আরও ৯০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে গ্রুপটি।
সাদ মুসা গ্রুপের টেক্সটাইল খাতে শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারপরও, সুলতানা হাবিবা ফ্যাব্রিক্স মিলের মতো আরেকটি বড় কারখানা স্থাপন করছে, তৈরি পোশাক ও গৃহস্থালি টেক্সটাইলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে। আগামী বছরে নতুন কারখানায় উৎপাদন শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে।
অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়ে এরমধ্যেই ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে মিলটির আংশিক নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেছে গ্রুপটি। এখন বিদেশি ঋণে দরকারি যন্ত্রপাতি ক্রয়ের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে।
সাদ মুসা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মহসিন টিবিএসকে জানান, ইতোমধ্যে চীন, বেলজিয়াম ও জার্মানির কয়েকটি ব্যাংক ৩ শতাংশ সুদে প্রায় ৩২৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে রাজি হয়েছে।
তিনি বলেন, 'ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছি'।
গ্রুপের মূল ব্যবসা টেক্সটাইল খাত- বিশেষত হোম টেক্সটাইল কেন্দ্রিক হলেও, ভবিষ্যতের বাজার ও ব্যবসা সম্ভাবনা মাথায় রেখে ইতোমধ্যেই অন্যান্য খাতেও ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে এবং আরও সম্প্রসারণের পরিকল্পনাও নিয়েছে।
২০২৫ সালের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র, অটো ব্রিকস, কৃষি-ভিত্তিক প্রকল্প, সিমেন্ট ও ইস্পাত শিল্প এবং ২০৩০ সালের মধ্যে আবাসন খাতে ব্যবসা বৈচিত্র্যকরণের পরিকল্পনা করছে সাদ-মুসা।
মোহাম্মদ মহসিন বলেন, '২০২৫ সালের মধ্যে নতুন কয়েকটি খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ হলে গ্রুপটিতে প্রায় ৩০ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। বর্তমানে আমাদের ২৭টি শিল্প ইউনিটে কর্মসংস্থান প্রায় ১২ হাজার।"
সম্প্রসারণ পরিকল্পনার অধীনে, ডালডা, ভেজিজেটেবল অয়েল এবং অন্যান্য তেল উৎপাদনে ৩০ মিলিয়ন ডলার, ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এইচএফও (হেভি ফুয়েল অয়েল) বিদ্যুতকেন্দ্রে ১৭৫ মিলিয়ন ডলার, পরিবেশ-বান্ধব অটো ব্রিকসে ২০ মিলিয়ন ডলার এবং কৃষি-প্রকল্পে ৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।
প্রতিবছর ১০% হারে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকা সিমেন্ট শিল্পেও বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সাদ মুসা গ্রুপ, যার জন্য চট্টগ্রামের শিকলবাহায় ২০ একর জমিও কিনেছে।
২০২৫ সালের মধ্যে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ইস্পাত কারখানা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছে, এজন্য আরও ২০ একর জমি কিনেছে। এই কারখানায় দৈনিক ১,০০০ টন ইস্পাত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্প খরচের বিষয়ে গ্রুপটির কর্মকর্তারা বলেছেন, এটা বাস্তবায়নের সময়ের ওপর নির্ভর করবে।
কক্সবাজারে সাত তারকা মানের অবকাশকেন্দ্র এবং আবাসন খাতেও বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে গ্রুপটি।
প্রক্রিয়াধীন বিদেশি ঋণ
২০১৬ সালে সুলতানা হাবিবা ফ্যাব্রিক্স মিল গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয় সাদ-মুসা।
ওই সময় ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) মিলটিতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। সুলতানা হাবিবা ফ্যাব্রিক্স মিলের জন্য ঋণমঞ্জুরির মাধ্যমে ৪৮৫ কোটি টাকার অনুমোদন দেয়। নিজেরা বিনিয়োগের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়াত্ত চারটি ব্যাংক থেকে ৮৯০ কোটি টাকা ঋণ ব্যবস্থা করে দিতে লিড অ্যারেঞ্জারও ছিল আইসিবি।
সবমিলিয়ে আইসিবি থেকে ১ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা ঋণের অনুমোদন পেয়েছিল সাদ-মুসা গ্রুপ।
তবে পুঁজিবাজারের বাইরে বিনিয়োগের কারণে, আইসিবির ৪৮৫ কোটি টাকার বিনিয়োগ বাতিল করা হয়। রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলোর অনুমোদিত ঋণও বাতিল হয়ে যায়।
মোহাম্মদ মহসিন টিবিএসকে বলেন, ১,৩৭৫ কোটি টাকার ঋণ পাইপলাইনে থাকায় সাদ মুসা গ্রুপ নিজস্ব তহবিল ও অন্যান্য ব্যাংক থেকে ৭০০ কোটি টাকা নিয়ে ১২ লাখ বর্গফুটের মিলটির নির্মাণ কাজ শুরু করে। তবে আইসিবির ঋণ মঞ্জুরি বাতিল হওয়ায় মেশিনারিজ আনা সম্ভব হয়নি।
স্থানীয় ব্যাংকগুলোর কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে, নতুন টেক্সটাইল মিলটি নির্মাণে বিদেশি ঋণদাতাদের দ্বারস্থ হয় সাদ মুসা গ্রুপ। তাতে সাড়া দিয়ে, চীন, বেলজিয়াম ও জার্মানি- ভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংক যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ৩২৫ মিলিয়ন ডলারের ঋণ দিতে রাজি হয়েছে।
বিদেশি ঋণদাতাদের মধ্যে– চীনের এগ্রিকালচারাল ব্যাংক দিবে ৭৮.৩৩ মিলিয়ন বা প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। জার্মানির ল্যান্ডসব্যাংক বাডেন-উর্টেমবার্গ ২৫ মিলিয়ন ডলার ও অল্ডেনবুর্গিশে ল্যান্ডসব্যাংক এজি আরও ২৫ মিলিয়ন এবং ব্যাংক অব বেলজিয়াম দেবে ১৫ মিলিয়ন ডলার।
বিডার কাছে অনুমোদনের আবেদন
চলতি বছরের ৪ আগস্ট বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (বিডা) দেওয়া চিঠিতে, সুলতানা হাবিবা ফ্যাব্রিক্স মিলের যন্ত্রপাতি কিনতে এগ্রিকালচারাল ব্যাংক অব চায়নার ৭৮ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়ার অনুমোদন চেয়েছে সাদ মুসা গ্রুপ।
গ্রুপটির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান– সুলতানা হাবিবা ফ্যাব্রিক্স মিলের পক্ষ থেকে দেওয়া ওই চিঠিতে বলা হয়, 'এগ্রিকালচারাল ব্যাংক অব চায়নার কিংডাও শাখা স্থানীয় (বাংলাদেশি) কোনো ব্যাংক গ্যারান্টি ছাড়াই, শুধুমাত্র আমাদের কর্পোরেট গ্যারান্টরের আস্থায়– ৭৮.৩৩ মিলিয়ন ঋণচুক্তির ৮৫ শতাংশ চায়না এক্সপোর্ট অ্যান্ড ক্রেডিট ইনস্যুরেন্স কর্পোরেশনের সম্মতি অনুযায়ী অর্থায়ন করতে চায়।"
দুঃসময় যেভাবে আসে
২০১০ সালে আগ পর্যন্ত ভালো ব্যবসা করলেও একটি ঘটনা গ্রুপটিকে সংকটে ফেলে,যার মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রামের অদূরে আনোয়ারা উপজেলায় সাদ-মুসা শিল্প পার্কগড়ে তোলা।
এখানে গ্রুপটি বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের ২৪টি কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা করে। কিন্তু গ্যাস-বিদ্যুত সংযোগের অভাবে উৎপাদনে যেতে না পারায়, বড় ধরনের লোকসান হয় গ্রুপটির।
২০১৫ সালে এই পার্কটির কয়েকটি ইউনিট চালু হলেও গ্যাস-বিদ্যুতের অভাব রয়েছে এখনো। আর সবগুলি কারখানা চালু করতে না পারায়, পার্কটি এখনও লোকসান গুনছে।
এছাড়া, আমেরিকায় একটি গুদাম কিনতে গিয়েও আইনি ঝামেলায় পড়েন সাদ মুসা গ্রুপের কর্ণধার। তাতেও বড় ধরনের লোকসান হয়।
রাষ্ট্রায়ত্ত কর্ণফুলী জুট মিলস ভাড়া নিয়েও জটিলতায় পড়ে। লোকসানে থাকা এই মিলটি ২০০৮ সালে ভাড়া নিয়ে উৎপাদন শুরু করে সাদ মুসা গ্রুপ।
তবে চার বছরের ব্যবধানে ২০১২ সালে, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মিলটিকে আবার সরকারের কাছে ফেরত দিতে হয়। কিন্তু তার আগেই কারখানাটির আগের গ্যাস-বিদ্যুত বিলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বকেয়াসহ প্রায় ৩০০ কোটি টাকা পরিশোধ করে সাদ-মুসা গ্রুপ।
সাদ মুসা গ্রুপের ব্যাংক ঋণ
রাষ্ট্রায়ত্তসহ প্রায় এক ডজন ব্যাংকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ রয়েছে সাদ-মুসা গ্রুপের।
২০০৫ সালে তাদের একটি ফ্যাক্টরি পুড়ে যাওয়া, আইসিবির ঋণ না পাওয়া এবং করোনায় ব্যবসায় মন্দার কারণে ঋণের একটি অংশ খেলাপি হয়েছে।
কিছু ঋণ কিস্তি দিয়ে পুনঃতফসিল করে নিয়মিত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ মহসিন বলেন, '১৯৮২ সাল থেকে ব্যবসা করছি। এই সময়ে ঋণ পরিশোধে কোনো সমস্যা হয়নি। তবে কিছু ঘটনার কারণে সমস্যা হয়েছে। সমাধানে আমরা চেষ্টা করছি'।
সাদ মুসা গ্রুপের উত্থানের কাহিনি
১৯৮২ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে এক বাল্যবন্ধুর থেকে টাকা ধরা করে ব্যবসা শুরু করেন মোহাম্মদ মহসিন। যদিও তার বাবা আবু সাদ চৌধুরী চেয়েছিলেন ছেলে যেন চাকরিজীবী হয়।
শুরুতে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা শুরু করেন তিনি। তবে প্রথমবার ব্যবসায় লোকসান হলে সব মূলধন শেষ হয়ে যায়। তাতে দমে যাননি উদ্যমী তরুণ মহসিন, এরপর ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মাধ্যমে আবারও ব্যবসা শুরু করেন।
এর কয়েক বছর পর জাহাজ নির্মাণ খাতে ব্যবসা শুরু করেন। ধীরে ধীরে এ ব্যবসায় সাফল্য পেতে থাকলে, টেক্সটাইল খাতে ব্যবসা শুরু করেন।
মহসিনের প্রথম শিল্পোদ্যোগ ছিল- চিটাগং ফাইবার বোর্ডস, যা লেদার ফাইবার শিট এবং সিলভার ক্যান উৎপাদন ও সরবরাহ করতো।
১৯৯৪ সালে তিনি তার বাবা ও চাচার নামে সাদ মুসা গ্রুপ গঠন করে বিভিন্ন খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ শুরু করেন।
এরপর থেকে মহসিনকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ধীরে ধীরে নানান খাতের এক ডজনের বেশি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান নিয়ে এক মহীরুহে পরিণত হতে থাকে সাদ মুসা গ্রুপ।
বর্তমানে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ১০০ একর জমিতে সাদ মুসা শিল্প পার্ক নির্মাণ করছে।
এখানে সব ধরনের শিক্ষার সুবিধাসহ ১০০ বিঘা প্লটে একটি শিক্ষা পার্ক, ৪০ বিঘা জমিতে একটি হাসপাতাল, বসবাসের জন্য পরিকল্পিত গ্রাম, টেক্সটাইল চাহিদা পূরণে মিল এবং খাদ্য উৎপাদনের জন্য কৃষি প্রকল্প থাকবে।