ব্যবস্থাপনায় পরিচালকদের হস্তক্ষেপ ব্যাংকেরই ক্ষতি: গভর্নর
ব্যাংকের সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যাংক ব্যবস্থপনার কাজে পরিচালকের হস্তক্ষেপ করতে নিষেধ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। নির্দিষ্ট দায়িত্বের বাইরে হস্তক্ষেপ করলে, তাতে ব্যাংকেরই ক্ষতি হয় বলে পরিচালকদের সতর্ক করেছেন তিনি।
শনিবার (২৭ আগস্ট) ঢাকার মিরপুরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) আয়োজিত 'নবম বার্ষিক ব্যাংকিং কনফারেন্স'-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, "ব্যাংকের পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তাদের দায়িত্ব ও কাজ সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী তারা কাজ করবেন।"
"পরিচালকরা ব্যবস্থাপনার কাজ করবেন না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারাই ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করবেন", লিখিত বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি।
গভর্নর বলেন, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যাংক মালিকদের সংগঠন এবং ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠনের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করে এসব কথা জানিয়ে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ইউক্রেইনের ওপর রাশিয়ার আগ্রাসনে বিশ্বে সরবরাহ ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর জেরে দেশে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারও বেশ চাপে পড়েছে।
এ পরিস্থতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন কোনো উদ্যোগ নেবে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে গভর্নর বলেন, আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশা করছেন তিনি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বড় ধরনের উদ্বেগ নেই দাবি করে তিনি বলেন, "এখন যে মূল্যস্ফীতি, তা কিন্তু আমদানির কারণে … তেল ও সার কিনে আনতে হয়। তেলের দাম বেড়েছে। বিকল্প উপায়ে কম দরে সার কেনার চেষ্টা চলছে। পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক যে পদ্ধতিতে এগোচ্ছে বাংলাদেশ ভালোর দিকেই আছে।"
সম্প্রতি বৈদেশিক মুদ্রাবাজার অস্থিতিশীল পরিবেশের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ডলারের দাম ব্যাংকেই ১১০ টাকা আর খোলা বাজারে ১২০ টাকায় উঠেছিল।
ডলার লেনদেনে অতিরিক্ত মুনাফা করায় সম্প্রতি দেশি ও বিদেশিসহ ছয়টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে অপসারণ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ বিষয়ে পরবর্তী কী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, "বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে। তদন্ত শেষ হলে কথা বলব।"
বৈদেশিক মুদ্রাবাজার যে বেশ চাপে রয়েছে, তা উঠে এসেছে এবারের বার্ষিক ব্যাংকিং কনফারেন্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেওয়া অধ্যাপক শাহ মো. আহসান হাবিবের মূল প্রবন্ধেও।
সেখানে তিনি বলেন, "মূল্যস্ফীতির বর্তমান চিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যাপ্ত উদ্যোগ না নিলে বাজেটে নেওয়া বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে।"
এ প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, "অভ্যন্তরীণ সববরাহ বাড়িয়ে বৈশ্বিক এ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক যে উদ্যোগ নিচ্ছে, তাতে আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে।''
মূলপ্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, মুদ্রাবাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে মুদ্রানীতিতে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির চাপে ঋণ প্রবাহ কমে যাওয়া মানেই অর্থ পরিশোধ কমে যাবে ব্যাংকে। ফলে বেড়ে যেতে পারে খেলাপির পরিমাণ।
যদিও মূল্যস্ফীতির এই চাপের মধ্যে একাধিক অর্থনীতিবিদ ঋণের সুদহার তুলে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এ বিষয়ে গভর্নর বলেন, "সুদহার সীমা তুলে দিলে অর্থ খরচ আরও বাড়বে উদ্যোক্তাদের। পাশাপাশি, ব্যাংকেরও তহবিল ব্যবস্থাপনার খরচ বৃদ্ধি পাবে। আমরা উদ্যোক্তাদের কম খরচে ঋণ দিতে চাই। যাতে উৎপাদন খরচ কমে আসে।"
সুশাসনের ওপর জোর দিয়ে গর্ভনর বলেন, ব্যাংক শুধু মুনাফাই করবে না, সুশাসনের চর্চাও অব্যাহত রাখবে, নইলে পুরো খাতটিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
অনুষ্ঠানের সূচনা বক্তব্যে বিআইবিএম এর মহাপরিচালক ড. আকতারুজ্জামান বলেন, "বার্ষিক ব্যাংকিং কনফারেন্স ব্যাংকারদের নিজেদের কাজের অভিজ্ঞতা ও চ্যালেঞ্জ পরস্পরের সঙ্গে বিনিময় করার একটি সুযোগ তৈরি করে দেয়।"
প্রতিবছর বার্ষিক ব্যাংকিং কনফারেন্সের আয়োজন করে বিআইবিএম। এতে দেশি-বিদেশি ব্যাংকাররা অংশ নেন। ব্যাংক পরিচালনায় বিষয়ভিত্তিক প্লেনারি সেশনে একাধিক প্রেজেন্টেশন পেপার উপস্থাপন করা হয়।
কোভিড মহামারির কারণে গত ২০২০ ও ২০২১ সালে এ আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। দুই বছরের বিরতির পর এবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দুই দিনব্যাপী এ আয়োজনে এবার ভারত, মালয়েশিয়া ও নেপাল থেকে ব্যাংকাররা অংশগ্রহণ করছেন অনলাইনে।
প্রথম দিনের আলোচনায় সামষ্টিক আর্থিক পরিবেশ এবং আর্থিক খাত বিষয়ে ৪টি প্যানেল ডিসকাশন হয়। প্রতিটি প্যানেল আলোচনায় ৩টি বিষয়ে আলোচনা করা হয়।
প্রথম প্যানেল আলোচনায় মাইক্রোফিনান্স ইনস্টিটিউট-এর নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে. মুজেরির সভাপতিত্বে আলোচানায় অংশ নেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, ড. সরওয়ার উদ্দিন আহমেদ, মোঃ নেহাল আহমেদ এবং মোশাররফ হোসেন।