রেকর্ড বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির মধ্যে আরএমজির কার্যাদেশ ৩০ শতাংশ কমে গেছে
ইউরোপ ও আমেরিকায় রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে মূল্যস্ফীতির হার। এর ধাক্কায় এ দুই বাজারের ক্রেতারা নতুন পোশাক ও ফ্যাশন সামগ্রী কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে বাংলাদেশের অধিকাংশ তৈরি পোশাক (আরএমজি) কারখানা সক্ষমতার চেয়ে ৩০ শতাংশ কম কার্যাদেশ পাচ্ছে। ফলে আসন্ন কঠিন সময়ে টিকে থাকার লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে দেশের তৈরি পোশাক শিল্প।
অথচ মাত্র কয়েক মাস আগেও পরস্থিতি ছিল একেবারে উল্টো। ওই সময় বিপুল কার্যাদেশ পাচ্ছিল দেশের পোশাক কারখানাগুলো।
করোনা মহামারির পর পুনরুদ্ধারে সময় লাগার যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ দিকে সেই শঙ্কা উড়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, আশঙ্কার জায়গায় দেখা দেয় আশা।
মহামারিকালে এইচঅ্যান্ডএম ছাড়া বাকি প্রায় সব ব্র্যান্ডই ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের কার্যাদেশ বাতিল করে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তৈরি পোশাক খাত। প্রতিটি বড় শিল্পই মন্দার মুখে পড়ে। এ সময় বস্ত্র রপ্তানি ৩৪.১৩ বিলিয়ন ডলার থেকে ২৭.৯৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
চাহিদা কমে যাওয়া ছাড়াও ফ্রেইট খরচ প্রায় চার গুণ বেড়ে যায়, আর অন্যান্য উপকরণের সাথে কাঁচামালের দামও বেড়ে যায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ।
কিন্তু এ অর্থবছরে তৈরি পোশাক শিল্প শক্তভাবে ঘুরে দাঁড়ায়। ২০২১-২২ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয় ৪২.৬১ বিলিয়ন ডলার। যা আগের সর্বোচ্চ আয়ের চেয়েও প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার বেশি।
আশা দেখিয়েও হতাশা উপহার
কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন করে আরেকবার সংকটের মধ্যে পড়ে যাওয়ায় পোশাক শিল্প ধাক্কা খাওয়ায় এ উত্থান দীর্ঘস্থায়ী হলো না।
দুর্ভোগের শুরু ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে। রাশিয়াকে পর্যুদস্ত করার জন্য দেশটির ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এর জেরে সৃষ্ট জ্বালানি সংকটে ইউরোপীয় অর্থনীতি নাভিশ্বাস ওঠে। চড়চড় করে বাড়তে থাকে মুদ্রাস্ফীতির হার, তার ধাক্কা লাগে বাজারে। অচিরেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছে যায়।
আর সেই উত্তাপ এসে লাগে দেশের আরএমজি খাতে। জুলাই থেকে আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আরএমজি কারখানাগুলো তাদের উৎপাদন সক্ষমতার ৭০ শতাংশ বুকিং অর্ডার পাচ্ছে বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি বেশিরভাগ কারখানাই অতিরিক্ত সক্ষমতা নিয়ে কাজ করছিল। অনেক কারখানাই তাদের আকার বাড়িয়েছে বা ডাবল-শিফট শুরু করেছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতিতে আসন্ন মাসগুলোর পোশাকের অর্ডার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মন্দার আশঙ্কা বিশ্বব্যাপী পোশাকের চাহিদার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমার কারখানা সামনের মাসগুলোর জন্য ১৬ শতাংশ কম অর্ডার পাচ্ছে।'
তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে মহামারির অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে এ শিল্প অনিশ্চয়তা কাটিয়ে উঠতে পারবে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) পরিচালক এবং নিপা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. খসরু চৌধুরী বলেন, তার কোম্পানি প্রতি মাসে ৩০ লাখ পিস পোশাক তৈরি করে। কিন্তু আগামী নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তার কোম্পানির সক্ষমতার মাত্র ৫০ শতাংশ বুক করা হয়েছে।
তিনি বলেন, 'আমি আরও অর্ডারের খোঁজে আছি। কিন্তু যে মূল্য বলা হচ্ছে, তা আমার [উৎপাদন] খরচের চেয়ে কম হওয়ায় অর্ডারের পূরণ করতে পারছি না। ছয় মাস আগে যে পরিমাণ অর্ডার পাচ্ছিল, তার থেকে ১০-১২ শতাংশ কম পাচ্ছি এখন। আমি সক্ষমতা অর্ধেক করব না, কিন্তু সেজন্য কিছুটা ক্ষতি মেনে নিতে হবে। এছাড়া লোকসান যাতে ভাগাভাগি করে নেয়া যায়, সেজন্য ক্রেতাদের সাথে আলোচনা করছি।'
খসরু চৌধুরী আরও বলেন, 'এই মুহূর্তে আমার প্রফিট মার্জিন ২ থেকে ৫ শতাংশ। আউটারের জন্য ফ্রেইট-অন-বোর্ড (এফওবি) মূল্য পড়ে ৫ থেকে ১৪ ডলার প্রতি পিস, এবং উৎপাদন খরচ ২ থেকে ৫ ডলার। এখন আমাকে ৫ থেকে ৭ শতাংশ লোকসান দিতে হবে। তবে মহামারির অভিজ্ঞতা থেকে আশা করছি ফেব্রুয়ারির পরে ব্যবসা আবার চাঙা হবে। ওই সময় বসন্ত ও গ্রীষ্মের জন্য নতুন চালান যায়।'
বড় সমস্যা খরচ বৃদ্ধি ও কার্যাদেশ কমা
খরচ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে মো. খসরু চৌধুরী বলেন, 'তুলার দাম কমছে। কিন্তু যুদ্ধের কারণে পেট্রোকেমিক্যালের দাম বেড়ে গেছে। এজন্য কাঁচামালের মোট দাম ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। অন্যদিকে ব্র্যান্ডগুলো দাম কমানোর জন্য দরকষাকষি করছে।'
চট্টগ্রামভিত্তিক আরডিএম গ্রুপের চেয়ারম্যান রকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, তার মাসিক সক্ষমতা ছিল ১৩ লাখ, কিন্তু জুলাই ও আগস্টের জন্য তার অর্ডার ছিল মাত্র ৬-৭ লাখ। অথচ এক মাস আগেও উৎপাদন চাহিদার চাপ সামলানোর জন্য তাকে ১৪ ঘণ্টা কারখানা চালু রাখতে চালাতে হয়েছে।
কার্যাদেশ কমে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আসন্ন বসন্ত ও গ্রীষ্ম মৌসুমে ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন (ইউডি) ৩০ শতাংশ।
তিনি বলেন, 'চার মাস আগের তুলনায় এনকোয়্যারি ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।' এক মাস পরও একই পরিস্থিতি দেখা যেতে পারে বলেও জানান মোহাম্মদ হাতেম।
তারল্য সংকটে পড়বে বলে অনেক কারখানা ডিসেম্বরের পর থেকে শ্রমিকদের মজুরি দিতে পারবে না বলে জানান তিনি।
তার মতো প্রায় একই কথা শোনালেন স্প্যারো গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজের এমডি শোভন ইসলাম। তিনি বলেন, হাই-ভ্যালু ব্র্যান্ডগুলোর অর্ডার ১০ শতাংশ কমেছে, আর যারা মৌলিক পণ্যের ওপর জোর দেয় তাদের অর্ডার কমেছে ৩০ শতাংশ।
শোভন বলেন, আগস্ট-ফেব্রুয়ারিতে অর্ডারের ঘাটতি থাকবে।
তিনি আরও বলেন, 'এখন যে ভয় কাজ করছে, তার কারণ মূল্যস্ফীতি ও মন্দা। এটি কাটিয়ে উঠতে আমাদের ৬ থেকে ৮ মাস অপেক্ষা করতে হতে পারে।'
প্লামি ফ্যাশন লিমিটেডের এমডি এবং বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, গত বছর অনেক অতিরিক্ত কার্যাদেশ ছিল। সেই অতিরিক্ত কার্যাদেশে ভারসাম্য আনা হচ্ছে বলে বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
কমছে ইউরোর মূল্য, পোশাকের চাহিদাও
তবে এর মাঝেই এক নতুন মাত্রাও দেখছেন বলে জানান শোভন। 'মন্দার কারণে ইউরো আর ডলারের মান এখন প্রায় একই। এর অর্থ, ইউরোপের প্রধান বাজারগুলোতে আমাদের পণ্যের চাহিদা হ্রাস পাবে, কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। এটি সমন্বয় করার জন্য ব্র্যান্ডগুলো আমাদের দাম কমাতে বাধ্য করতে পারে।'
এ পরস্থিতির প্রতিকারের জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপাতত কোনো সমাধান উপায় নেই। 'এখন আমাদের জন্য টিকে থাকাটাই সবচেয়ে বড় কথা,' বলেন তিনি।
এনভয় টেক্সটাইল লিমিটেডের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদও জানালেন, মন্দার কারণে গ্রাহকরা তাদের অগ্রাধিকার বদলে ফেলেছে। 'তারা পোশাকের বদলে খাদ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পেছনে খরচ করছে। আর তারই প্রতিফলন দেখছি অর্ডারের সংখ্যায়।'
কিউট ড্রেস ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের এমডি শেখ এইচএম মুস্তাফিজ বলেন, একমাত্র সমাধান হলো যুদ্ধ শেষ হওয়া। এছাড়া এই মুহূর্তে আর কোনো সুনির্দিষ্ট সমাধান পাওয়া যাবে না।
বিজিএমইএর সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, সদস্যরা জানিয়েছে, টার্গেট ও ওয়ালমার্ট কনফার্ম করা অর্ডার বাতিল করেছে।
এ দুই খুচরা বিক্রেতার কাছেই প্রচুর অবিক্রীত পণ্য রয়ে গেছে বলে জানানো হয়েছে ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে। তারা এখন পণ্য বুঝে নেওয়ার জাস্ট-ইন-টাইম পদ্ধতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
প্রধান আমেরিকান খুচরা বিক্রেতাদের ইনভেন্টরি ৪৪.৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। এর অর্থ, অনেকেই আপাতত ভবিষ্যতের জন্য কেনাকাটা বন্ধ করে দিচ্ছে।
এর মধ্যেই শোনা যাচ্ছে শিপমেন্ট দুই মাস পর্যন্ত বিলম্বিত করার অনুরোধও করা হচ্ছে। এর অর্থ হলো, মূলধন আটকা পড়বে এবং ব্যাংকের দায় বাড়বে।
নাম না প্রকাশের শর্তে একজন আরএমজি মালিক বলেন, তিন লাখ পিস হাই-ভ্যালু পোশাকের চালান স্থগিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, 'ব্র্যান্ডগুলো এখন আমার কারখানাকে গুদাম হিসাবে ব্যবহার করছে।'
নাম না প্রকাশের শর্তে একটি বায়িং হাউসের প্রধান বলেন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার বাজারের অর্ডার প্লেসমেন্টের প্রবৃদ্ধি এখনও একই গতি ধরে রেখেছে। তিনি আরও জানান, সম্প্রতি কোরিয়া সফরে তিনি দেখেছেন যে মূল্যস্ফীতির ফলে পোশাক ছাড়া বাকি সব পণ্যেরই দাম বেড়ে গেছে।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধের কারণে জ্বালানি ও খাদ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় গত মে মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চে পৌঁছে। রাষ্ট্রচালিত স্ট্যাস্টিস্টিকস কোরিয়ার তথ্য অনুসারে, গত মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যমূল্য বেড়েছে ৫.৪ শতাংশ, আর গত এপ্রিলে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় পণ্যমূল্য বেড়েছিল ৪.৮ শতাংশ।
বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, তারা ২০ শতাংশ ইউডি কমেছে। তিনি আরও বলেন, রপ্তানিকারকরা শিপমেন্ট স্থগিত হয়ে যাওয়ার কথাও জানাচ্ছেন। তবে কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও কোনো কার্যাদেশ বাতিলের খবর কেউ জানায়নি।