ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, চাল আমদানিতে শঙ্কা
স্থানীয় বাজারে সরবরাহ বাড়িয়ে দাম কমানোর উদ্দেশ্যে চাল আমদানির যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার, তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি।
ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় আমদানি করা চাল বাজার পর্যন্ত আসতে যে খরচ পড়বে তা স্থানীয় বাজারের বর্তমান দামের চেয়েও বেশি। ফলে, অনুমতি নেওয়া ব্যবসায়ীরা চাল আমদানিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
আমদানিকারকরা বলছেন, বেসরকারিভাবে যে চাল আমদানি করা হয় তার ৮০ ভাগেরও বেশি আসে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ফুড গ্রেইনের আন্তর্জাতিক বাজার অস্থির হলেও চালের দামে এই আঁচ লাগেনি।
আমদানিকারকদের দেওয়া তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ভালো বি-আর ২৮ জাতের যে সরু চাল রয়েছে, ভারত এই মানের প্রতি টন চাল রপ্তানি করছে ৪৩০-৪৩৫ ডলারে।
এদিকে, এলসি খুলতে গেলে এক ডলারের বিপরীতে ব্যবসায়ীদেরকে খরচ করতে হচ্ছে ৯৮ টাকা, যা গত বছরের এই সময়ে ছিল ৮৪-৮৫ টাকা। ৯৮ টাকা হিসেবে এক টন চালের মূল্য দাঁড়াচ্ছে সর্বোচ্চ ৪২, ৬৩০ টাকা।
আবার, চাল আমদানিতে রয়েছে ২৫ শতাংশ শুল্ক। শুল্ক ও এলসি প্রসেসিংসহ অন্যান্য খরচ মিলে এর পরিমাণ ২৭ শতাংশ দাঁড়ায়।
এই হিসাবে শুল্কায়নের পর বাংলাদেশে আসা প্রতি কেজি চালের মূল্য দাঁড়াবে ৫৪ টাকার উপরে।
মিল মালিকরা বলছেন, মিলগেটে এখন বিআর-২৮ জাতের প্রতি কেজি চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৮-৪৯ টাকা। অর্থাৎ আমদানি হওয়া প্রতি কেজি চালের দাম মিলগেটের চেয়েও অন্তত ৫ টাকা বেশি।
একইভাবে হিসাব করে দেখা গেছে, ৩৯০ ডলারে মোটা চাল আমদানি করলে তার খরচ দাঁড়াবে ৪৮ টাকার বেশি, যেখানে মিলগেটে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৩ টাকায়।
ব্যবসায়ীরা বলছে, এক কেজি চালের দামে এ বছর অন্তত ৬ টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে শুধুমাত্র ডলারের দামের কারণে।
অর্থাৎ আমদানি পর্যায়ে যে দাম, তা পাইকারী বিক্রেতাদের মাধ্যমে হাতবদল হয়ে খুচরা বাজারে আসতে খরচ আরও অনেকখানি বেড়ে যাবে। মিলগেটে একই মানের চাল কম দামে পাওয়া গেলে আমদানিকারকরা চাল আনলেও তাদের কাছ থেকে কিনতে চাইবে না ব্যবসায়ীরা। এসব হিসেব নিকেশ করে আমদানির অনুমতি নিলেও এখনই চাল আনছেন না ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা জানান, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও পাকিস্তান থেকেও চাল আমদানির সুযোগ রয়েছে। তবে এসব দেশ থেকে চাল আমদানি করতে হলে খরচ আরও কিছুটা বাড়বে।
বাংলাদেশ অটো মেজর এন্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সহ সভাপতি শহিদুর রহামন পাটোয়ারী ৭ হাজার মে টন চাল আমদানির অনুমতি নিয়েছেন। কিন্তু অনুমতি পাওয়ার সপ্তাহখানেক পার হলেও তিনি এলসি খুলেননি।
এই আমদানিকারক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ভারতে চালের দাম বাড়েনি। বরং ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় তারা দাম কিছুটা কমিয়েছেন। কিন্তু আমরা যারা আমদানি করছি তাদের জন্য এটা একটা সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।"
তিনি বলেন, "গত বছরের এই সময়ে ডলারের বিপরীতে খরচ হয়েছে ৮৪-৮৫ টাকা। এবারে সেটা কিনতে হচ্ছে ৯৮ টাকায়। ডলারের বাড়তি দামের কারণেই প্রতি কেজি চালে কমপক্ষে ৬ টাকার মত বাড়তি খরচ হচ্ছে।"
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (বৈদেশিক সংগ্রহ) টিবিএসকে বলেন, বুধবার পর্যন্ত ২১৮টি প্রতিষ্ঠানকে ৬ লাখ ৫৫ হাজার মে. টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীদের আবেদনগুলো যাচাই বাছাই করে এই অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।
মিলাররা বলছেন, চাল আমদানি করে কেউ লোকসান গুণতে চাইবে না।
ভারত থেকে চাল আমদানি করা যায় এক সপ্তাহের মধ্যেই। কিন্তু খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১ জুলাই ২০২২ থেকে ৫ জুলাই ২০২২ পর্যন্ত কোনো চাল আমদানি হয়নি। যদিও চাল আমদানির অনুমতি নেওয়া শুরু হয়েছে প্রায় দুই সপ্তাহ আগে থেকে।
গত বছরের ১৭ আগস্ট থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ৪১৫টি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১৭ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু আমদানির খরচ বেড়ে যাওয়ায় আমদানিকারকরা চাল আমদানিতে উৎসাহ দেখান নি। যে কারণে তখন মাত্র ৩ লাখ ৩১ হাজার টন চাল আমদানি হয়।
এবারে খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, প্রাথমিক অবস্থায় ১০ লাখ টনের অনুমতি দেওয়া হবে। এর প্রভাব দেখে পরে হয়তো আরও সাত লাখ টনের মত চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হতে পারে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন টিবিএসকে বলেন, "প্রাথমিক অবস্থায় ১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দিচ্ছি আমরা। ব্যবসায়ীদের মধ্যে চাল আমদানির প্রবণতা এবং বাজারে এর প্রভাব দেখে আমরা হয়তো আরও অনুমতি দিব। এটা শেষ পর্যন্ত গত বছরের সমপরিমাণই হতে পারে।"
তিনি বলেন, "আমাদের মূল উদ্দেশ্য সরবরাহ বাড়ানো। এজন্যই আমদানি করতে হচ্ছে।"
এদিকে ঘুর্ণিঝড়, বন্যা ও পাহাড়ি ঢালের কারণে এ বছর বোরো মৌসুমে চালের উৎপাদন কমে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। বাজারে ঠিক কী পরিমাণ ঘাটতি রয়েছে তা জানতে তিনি চাল উৎপাদনের প্রকৃত তথ্য সংগ্রহের অনুরোধ জানিয়েছেন কৃষি মন্ত্রণালয়কে।
তবে কৃষি মন্ত্রণালয় দাবি করছে, এবারও দুই কোটি টনের বেশি চাল উৎপাদন হবে। বিবিএসের তথ্য মতে, গত বোরো মৌসুমে ১ কোটি ৯৮ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চলতি বোরো মৌসুমে ধান ও চাল কিনছে সরকার। এই মৌসুমে ১৩ লাখ টন সিদ্ধ চাল, ৫০ হাজার টন আতপ চাল ও সাড়ে ৬ লাখ টন ধান কেনার লক্ষ্য রয়েছে।
কিন্তু এর বিপরীতে ১ লাখ ৩৪ হাজার টন বোরো ধান, ৬ লাখ ৪ হাজার ৫০০ টন সিদ্ধ ও সাড়ে ১৩ হাজার টন আতপ চাল কিনতে পেরেছে সরকার।
মাসখানেক আগে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক সভায় এবারের প্রকিউরমেন্ট পুরোপুরি সম্ভব হবে না বলেও শঙ্কা প্রকাশ করা হয়।