বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ অব্যাহত থাকবে
যেমনটা পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল, সেভাবেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। বিশ্ববাজার যেরকম অস্থিতিশীল আছে এবং আমদানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে আগামী মাসগুলোতেও রিজার্ভ চাপের মধ্যে থাকার সম্ভাবনাই বেশি।
২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের মে মাসের খোলা আমদানি ঋণপত্রের (এলসি) মোট মূল্য ছিল ৮৪ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৩ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।
চাল, পেঁয়াজ, ফল, ডাল, এমনকি পেট্রোলিয়াম পণ্যের জন্য বুকিংও কিছুটা কমেছে—তবে গম, ভোজ্য তেল, চিনি, দুগ্ধজাত খাবার, সার, পোশাকের কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতির জন্য এলসি খোলার পরিমাণ ব্যাপক বেড়ে যাওয়ায় তাতে তেমন কোনো লাভ হয়নি।
কম-প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি সীমিত করার জন্য কিছু নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলেও বাজার স্থিতিশীল ও শিল্পগুলোকে সচল রাখতে হলে কিছু বড় আইটেমের আমদানি বন্ধ করা যাবে না।
মঙ্গলবার দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনে বাংলাদেশ ব্যাংকের নবনিযুক্ত গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বলেছেন, 'তেল, গম, সার ও গ্যাসসহ মাত্র 8টি পণ্য আমদানি করতেই আমাদের বাড়তি ৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হয়েছে। এগুলোর দাম যদি না কমে তবে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হবে, কারণ এসবের উপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।'
বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম হ্রাসের প্রবণতা দেখা গেলেও, বিশ্ববাজারের যেরকম অস্থিতিশীল হয়ে আছে তাতে বিশ্লেষকরা এ থেকে খুব বেশি স্বস্তি পাওয়ার আশা করছেন না।
বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য এখনও বেশি থাকায় সামগ্রিক আমদানি বিল কমছে না।
এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের পরবর্তী রুটিন পেমেন্ট এবং মুদ্রাবাজার শান্ত রাখার জন্য প্রয়োজনে আরও ডলার বিক্রি করা হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ আরও কমে যাবে।
আকুর বিল পেমেন্ট
প্রতি দুইমাস পরপর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল পরিশোধ করা হয়। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মায়ানমার, নেপাল, পকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা আকুর সদস্য।
এই বিল পেমেন্টে প্রতি দুই মাসে গড়ে ২ বিলিয়নের কম-বেশি ডলার খরচ করতে হয় বাংলাদেশ ব্যাংককে।
সে হিসাবে প্রতি মাসে রিজার্ভ প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার কমে এই আমদানি বিল মেটাতে। আকুর পেমেন্ট নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গত ছয় মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল ৪৫ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। পরে মার্চের ৬ তারিখে আকুর বিল ২ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হলে সে রিজার্ভ নেমে আসে ৪৩ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলারে।
এর দুই মাস পর গত ১০ মে পরিশোধ করা হয় ২ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার। আগের দিন ৯ মে রিজার্ভ ছিল ৪৪ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। আকুর পেমেন্টের কারণে রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যায়।
সর্বশেষ গত সপ্তাহে ১ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। জুন শেষে যে রিজার্ভ ছিল ৪১ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার, এই বিল পেমেন্টের কারণে তা কমে ৩৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়ায়।
রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি
চলমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে প্রায় প্রতিদিনই ডলার বিক্রি করছে। মূলত খাদ্যপণ্য, জ্বালানি ও সরকারি কেনাকাটায় খোলা এলসি সেটেলমেন্টে এই সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০২১-২২ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ৭.৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। তবে সারা বছর একই অনুপাতে ডলার বিক্রি করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। গত কয়েক মাস ধরে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে।
১৩ জুলাই পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের প্রথম ১৩ দিনে ডলার বিক্রি হয়েছে ৫৭৪ মিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে বর্তমান পরিস্থিতিতে মাসে গড়ে ১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বুধবার ১৩ জুলাই রিজার্ভের পরিমাণ ৩৯ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার।
নিরাপদ রিজার্ভ কী?
দুই দশক আগে তিন থেকে ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে সক্ষম রিজার্ভকে নিরাপদ বিবেচনা করা হতো, কিন্তু এখন সে ধারণা বদলে গেছে। এখন স্বল্পমেয়াদী ঋণের শতাংশ হিসাবে রিজার্ভ, বৈদেশিক ঋণের অনুপাত, চলতি হিসাবের ঘাটতির শতাংশও—এসব ফ্যাক্টরও বিবেচনা করা হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন গভর্নর বলেছেন, তাদের লক্ষ্য হলো রিজার্ভকে ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যায় এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকতা জানান, একসময় দেশের রিজার্ভ ছিল ৩০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এখন বৈশ্বিক সংকটের মধ্যেও দেশের রিজার্ভ প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার।
'এখনই আতঙ্কিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি আমরা দেখছি না। তবে আমদানি কমানোর পাশাপাশি আমাদের যেন খরচও কম হয়, সেজন্য ব্যবস্থা নিচ্ছি। এখনই আতঙ্কিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি আমরা দেখছি না। তবে আমাদের যেন খরচ কম হয়, সে ব্যাপারে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমদানি কমানোর জন্য অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে এক্সপোর্ট ও রেমিট্যান্স ইনকাম কীভাবে বাড়ানো যায়, সেটি নিয়েও আমরা কাজ করছি,' বলেন ওই কর্মকর্তা।
কোনো নির্দিষ্ট পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে কি না জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, 'পরিস্থিতি যদি ওরকম হয়, তাহলে অপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। সময়ই বলে দেবে আমাদের কী পদক্ষেপ নিতে হবে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ সালেহউদ্দিন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, রিজার্ভ এখন যে পর্যায়ে আছে, সেটিকে আশঙ্কাজনক বলা যায় না।
'ন্যূনতম তিন মাসের আমদানি পেমেন্টের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়, আমাদের বেশিই আছে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের রিজার্ভ অনেক নেমে গেছে, এটা একটা চিন্তার ব্যাপার। এভাবে যদি রিজার্ভ নামতেই থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে এটা আমাদের জন্য ইস্যু হতে পারে,' বলেন তিনি।
রিভার্জকে বর্তমান পর্যায়ের রাখার উপরই জোর দিতে হবে উল্লেখ করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, 'টাকার মূল্যমানটা (ডলারের বিপরীতে) আর বেশি কমানো উচিত হবে না।
'কারণ এটি কমালে আমদানি খরচ, উৎপাদন খরচের মতো বিষয়গুলো বেড়ে যাবে। রপ্তানিকারকেরা কিছুটা সুবিধা পাবেন, তবে এতে টাকার প্রবাহ বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতির উপর চাপ ফেলবে।'
কম প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি কমানোর উপর জোর দেন সালেহউদ্দিন আহমেফ। তিনি বলেন, 'এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের (ইডিএফ) মাধ্যমে রিজার্ভ থেকে যে টাকাটা ঋণ দেওয়া হয়, সেটি যেন ফেরত আসে, এ বিষয়টা নজরে রাখতে হবে।
'নেট ওপেন পজিশনে (এনওপি) ব্যাংকগুলো চাইলে ডলার জমা রাখতে পারে। তারা সেখানে বেশি পরিমাণ অর্থ জমা রাখছে কি না, এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি করতে হবে। কার্ব মার্কেটের মাধ্যমে বা ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকাপয়সা বাইরে যাচ্ছে কি না, সেটিও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ বহুমুখী চিন্তাই এখন করতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ আমাদের অনেক বেড়ে গেছে। এরা ইচ্ছামতো ঋণ আনছে কি না ও ঋণ পরিশোধ করার সক্ষমতা আছে কি না, তা আমাদের আরো ভালোভাবে দেখতে হবে।
'মানে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে যেন আমরা খেলাপি না হই।'
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, গত বছরও দেশের ৯ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সক্ষমতা ছিল, অথচ এখন সেটি ৫ মাসে নেমে এসেছে।
তিনি বলেন, 'সেদিক থেকে দেখতে গেলে রিজার্ভ পরিস্থিতি অবশ্যই আমাদের কনসার্ন। অবশ্য আন্তর্জাতিকভাবে পণ্যের দাম বাড়ায় আমাদের আমদানি খরচ অনেক বেড়েছে।
'এই পরিস্থিতিতে এলসি মার্জিন প্রায় ১০০ শতাংশ রাখা, কিছু পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করা, এক্সচেঞ্জ রেট কিছুটা ফ্রি ফ্লোটের দিকে যাওয়াসহ সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যেটা প্রয়োজনীয় ছিল। পলিসির দিক থেকে এটা ঠিক আছে।'
প্রয়োজনে গাড়ি আমদানির ওপরও নিষেধাজ্ঞার পরামর্শ দেন অধ্যাপক মোস্তাফিজুর। 'এতে সরকারের আয় কমে যেতে পারে, তবে আমি মনে করি বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যালান্স অব পেমেন্ট স্থিতিশীল করার দিকেই সরকারের বেশি মনযোগ দিতে হবে।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি, রিজার্ভ ও বৈদেশিক মুদ্রার ওপর বিশাল চাপ রপ্তানি প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে প্রশমিত হয়নি।
আমদানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ও মুদ্রাবাজারে বিনিময় হার সমন্বয়ের চেষ্টার মতো কিছু নীতিগত পদক্ষেপ ঠিকমতো নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আরও উৎসাহিত হবে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে কিছুটা স্বস্তি দিতে প্রয়োজনে বিনিময় হারে আরও সমন্বয়ের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, 'এটা সত্যি যে রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে, তবু পরসিথিতি শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য দেশের মতো নয়। আমরা কিছু ব্যবস্থা নিয়েছি এবং আরও কিছু নেওয়া ব্যবস্থা প্রয়োজন।'
বৈশ্বিক জ্বালানি তেল, খাদ্য ও পণ্যের দামে কিছু সমন্বয় ও পুনর্বিন্যাস হতে পারে; তবে সামগ্রিকভাবে পণ্যমূল্য এখনও যুদ্ধপূর্ব অবস্থার চেয়ে বেশি আছে। 'বিশ্ববাজার এখন অস্থির এবং জ্বালানি, খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যের দামের চাপ অব্যাহত থাকবে।
'তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, এমনটা ভাবার অবকাশ নেই,' হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন অধ্যাপক সেলিম জাহান।
অত্যাবশ্যকীয় নয়, এমন পণ্যের জন্য এলসি মার্জিন বাড়ানো হলেও ভবিষ্যতে পরিস্থিতি দাবি করলে অতিরিক্ত শুল্ক বা সাময়িক আমদানি নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা যেতে পারে বলে পরামর্শ দেন স্থানীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান।
আরও সতর্কতা অবলম্বন এবং আমদানি-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কার্যকর বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, 'রিজার্ভ নিয়ে আমাদের আত্মতুষ্টিতে ভোগা বন্ধ করতে হবে। আর আমরা যাতে কখনও সংকটে না পড়ি, সেজন্য নীতিনির্ধারকদের আর কমফোর্ট জোনে থাকা উচিত নয়।'
এর আগে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ৭ বিলিয়ন রপ্তানি ক্রেডিট অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে প্রশ্ন তোলে আইএমএফ। সে প্রসঙ্গ তুলে অধাপক সেলিম রায়হান বলেন, 'একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে: আমাদের রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলার, নাকি ৩৩ বিলিয়ন ডলার?'