কনডোমিনিয়াম: দেয়ালের ভেতর আরেক শহর

ঢাকায় বাড়ি আছে সুপ্রিম কোর্টের একজন সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসির, কিন্তু তিনি থাকেন র্যাংস ওয়াটারফ্রন্টের একটি অ্যাপার্টমেন্টে। দেশের প্রথম বিলাসবহুল কনডোমিনিয়ামগুলোর একটি এটি।
২০০৮ সালে গুলশানে প্রায় ১৬ কোটি টাকায় অ্যাপার্ট্মেন্টটি কেনেন তিনি। কারণ রাজধানীতে নিজের বাড়িয়ে এত বড় খোলা জায়গা, সুইমিং পুল, বাগান ও হাঁটার জায়গা পাওয়া খুবই কঠিন।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সুপরিসর এলাকায় একই বাউন্ডারির মধ্যে প্রায় সব রকম নাগরিক সুবিধা থাকায় এবং সবুজায়নের কারণে এখানে অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে আগ্রহ পেয়েছি।"
গত দুই দশক ধরে দেশজুড়ে কনডোমিনিয়ামের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য অংশ খোলা জায়গা হিসেবে রাখায় ধনী ক্রেতারা এসব কমপ্লেক্স পছন্দ করে।
রাজধানীসহ সারা দেশে গত ১৬ বছরে দশকে প্রায় ১৮৪টি কনডোমিনিয়ামের প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে বলে জানিয়েছে আবাসন ব্যাসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)। এসব কনডোমিনিয়ামে প্রায় ৫ লাখ মানুষ থাকতে পারবে।
সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কনডোমিনিয়াম আছে ঢাকায় (৮০), চট্টগ্রামে (৩৪) এবং সিলেটে (১৪)।
রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন (কাজল) টিবিএসকে বলেন, গত দুই দশকে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে কনডোমিনিয়াম প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে।
রিহ্যাবের পরিচালক নাইমুল হাসান টিবিএসকে বলেন, এসব প্রকল্পে একই বাউন্ডারির মধ্যে প্রায় সব রকম নাগরিক সুবিধা থাকায় এসব প্রকল্পকে বলা হয় 'শহরের মধ্যে শহর'।
সাধারণ আবাসিক প্রকল্পের চেয়ে সুযোগ-সুবিধা বেশি হওয়ায় কনডোমিনিয়াম প্রকল্পে অ্যাপার্টমেন্টর দাম তুলনামূলক বেশি। এসব প্রকল্পে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী, রাজনীতিবীদ, আমলা ও প্রবাসীরা অ্যাপার্টন্ট কিনে থাকে।
রাজধানীতে কনডোমিনিয়াম প্রকল্পগুলোতে বিলাসবহুল ও সাধারণ, এ দুই ধরনের অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ করা হয়।
একজন আবাসন ব্যবসায়ী জানান, স্থানভেদে একটি লাক্সারি অ্যাপার্টমেন্টের দাম ১৫ থেকে ২৫ কোটি টাকা পর্যন্ত হয় আবার এলাকা ১-৫ কোটি টাকা পর্যন্ত সাধারণ অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হয়।
২০০৪ সালে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় প্রথম কনডোমিনিয়ামে প্রকল্প শুরু করে জাপান-বাংলাদেশ জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি।
পরে বিল্ডিং টেকনোলজিস অ্যান্ড আইডিয়াস লিমিটেড (বিটিআই), কনকর্ড রিয়েল এস্টেট লিমিটেড, নাভানা রিয়েল এস্টেট (এনআরইএল), শেলটেক (প্রাইভেট) লিমিটেড, নকশি হোমস লিমিটেড (এনএইচএল), সানমার প্রপার্টিজ লিমিটেড, র্যাংগস প্রপার্টিজ লিমিটেড, অ্যাসুর গ্রুপ, এবিসি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি, আর্টিসান রিয়েল এস্টেট কোম্পানি, ডোম-ইনো রিয়েল এস্টেট কোম্পানি, অ্যালায়েন্স প্রপার্টিজ, এপিক প্রোপার্টিজ লিমিটেড, এডিসন রিয়েল এস্টেট, রিজেন্ট ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড (আরডিডিএল) কনডমিনিয়াম নির্মাণ শুরু করে।
এ ধরনের প্রকল্প চট্টগ্রামে প্রথম বাস্তবায়ন করে সানমার প্রপার্টিজ। আর সিলেটে প্রথম ইস্ট ভ্যালি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড।
রাজউক চেয়ারম্যান এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী টিবিএসকে বলেন, এরকস প্রকল্প নাগরিকদের জন্য বেশ উপযোগী। এছাড়াও একটি আবাসিক এলাকায় যে ধরনের সুযোগ সুবিধা থাকার কথা সেগুলো থাকে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের বেসরকারি প্রকল্পকে উৎসাহিত করা হয়।
নতুন প্রকল্প বাড়ছে
কনডোমিনিয়াম প্রকল্প জনপ্রিয় হওয়ায় মিরপুর, মোহাম্মদপুর, রামপুরা, মালিবাগ, কাঁচপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে নতুন নতুন কনডোমিনিয়াম প্রকল্প হাতে নিয়েছে আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো। এমনও প্রতিষ্ঠান আছে, যারা একসঙ্গে তিনটি কনডোমিনিয়াম প্রকল্পের নির্মাণ কাজ একসঙ্গে করছে।
ঢাকার মিরপুরে বড় আকারে বিজয় রাকিন সিটি নামে কনডোমিনিয়াম প্রকল্প করেছে রাকিন ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি। সেখানে ১৬ একর জমিতে ৩৬টি ভবনে ১ হাজার ৯৫০ ফ্ল্যাট নির্মাণ করছে প্রতিষ্ঠানটি। পুরো প্রকল্পে ৬২ শতাংশ খোলা জায়গায় একাধিক খেলার মাঠ, সুইমিংপুল, হাঁটার জায়গা, কনভেনশন হল, বিদ্যালয় ইত্যাদি গড়ে তোলা হয়েছে।
ক্রেতাদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে কাঁচপুরে দেড়'শ বিঘা জমিতে নতুন একটি কনডোমিনিয়াম প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
বিজয় রাকিন সিটির পাশেই ৩০ বিঘা জমির ওপর নাভানা রিয়েল এস্টেট কনডোমিনিয়াম প্রকল্প করছে। সেখানে ৫২ শতাংশ জায়গা ছেড়ে দিয়ে ১ হাজার ৪৭৫ ফ্ল্যাট নির্মাণ করছে তারা।
প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে মিরপুর-১১ তে ১০ বিঘা ও মোহাম্মদপুরে ৬ বিঘা জমির ওপর নতুন প্রকল্প করছে।
মিরপুর মাজার রোডে ৭০ কাঠা জমিতে শেল্টেক্ বীথিকা নামে নিজেদের প্রথম কনডোমিনিয়াম করেছে শেলটেক। সেখানে ফ্ল্যাট রয়েছে ১৮৪টি। এ ছাড়া মালিবাগে ৩৭ কাঠা জমির ওপর শেলটেক এনক্লেভ টাওয়ার নামে আরেকটি কনডোমিনিয়াম করছে। সেখানে ১৩৫টি ফ্ল্যাট হবে।
বাড্ডায় ৪৮ কাঠার ওপর রেণু কবির টাওয়ার নামের কনডোমিনিয়াম প্রকল্পের কাজ চলছে। সেখানকার ১১৫টি ফ্ল্যাটের বিক্রি ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। চতুর্থ কনডোমিনিয়াম প্রকল্পটি হচ্ছে পান্থপথে এবং পঞ্চমটি হচ্ছে মোহাম্মদপুর এলাকায়।
রাজধানী ইন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে আরো নতুন ৭টি নতুন প্রকল্প অনুমোদনের জন্য আবেদন জমা আছে। এসব প্রকল্পের বিনিয়োগ হবে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।
সিলেট অ্যাপার্টমেন্ট অ্যান্ড রিয়েল এস্টেট গ্রুপের (সারেগ) সভাপতি শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল টিবিএসকে বলেন, সিলেট এলাকার একটি বড় সংখ্যক মানুষ দেশের বাইরে থাকে।
"বিদেশে অবস্থান করা প্রবাসীদের মধ্যে ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বেশি। তারা মূলত শহরের কাছাকাছি নিরিবিলি গ্রামীন পরিবেশে বাবা-মা বা নিকাত্মীদের জন্য আবাসন করতে বেশ উৎসাহী। আর এই সুযোগে এখন সিলেট বিভাগে এসব কনডোমিনিয়াম প্রকল্পের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।"
কিছু সমস্যা
কনডোমিনিয়ামগুলি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে, কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
মোহাম্মদপুরে রাজধানীর প্রথম কনডোমিনিয়াম জাপান গার্ডেন সিটি। জাপান গার্ডেন সিটি লিমিটেডের একটি প্রকল্পের আওতায় এ সিটি গড়ে উঠেছে ১০ একর জায়গায়। ভেতরে বর্তমানে ২০টি ভবনে ১ হাজার ৪৪৩টি পরিবারের বাস। আরও ছয়টি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে মোট ২৬টি ভবনে ১ হাজার ৬২৩টি পরিবার বসবাস করবে।
স্থপতি ইকবাল হাবীব টিবিএসকে বলেন, যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা এই প্রকল্পে পাওয়ার কথা, অ্যাপার্টমেন্ট ক্রেতা বা ভাড়াটিয়ারা সেটি সঠিকভাবে পাচ্ছে না।
"জাপান গার্ডেন সিটির ভেতরে কোনো গার্ডেন নেই। সুইমিং পুলেও পানি নেই। কংক্রিটের এই আবাসনের চারপাশে কোনো প্রাণের ছোঁয়া নেই।"
এছাড়াও এই আবাসিক এলাকায় এত বেশ লোকের বসবাস করার ব্যবস্থা করলেও, সে অনুযায়ী সুযোগ সুবিধা নেই বলে জানালেন তিনি।
"অনেক কনডোমিনিয়াম হচ্ছে, কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ সব বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কাজ করতে হবে", বলেন তিনি।