ইইউ’র রেক্স সিস্টেম: বাড়তি সময় ব্যয় ও হয়রানি থেকে মুক্তি রপ্তানিকারকদের

- রেক্স সিস্টেম বাংলাদেশে চালু হয় ২০১৯ সালে; পুরোপুরি অনলাইনভিত্তিক হয় ২০২১ সালের আগস্ট থেকে
- ইইউভুক্ত ২৭টি দেশসহ ৩৭টি দেশে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পায়
- ইপিবিতে রেক্স এর জন্য নিবন্ধিত হয়েছে ৩ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান
- বছরে ২ লাখের বেশি কান্ট্রি অব অরিজিনের সেল্ফ সার্টিফিকেশন যায় বাংলাদেশ থেকে
ইউরোপীয় ইউনিয়নের চালু করা নতুন সিস্টেমের ফলে ওই অঞ্চলে বাংলাদেশি পন্য রপ্তানির ক্ষেত্রে কান্ট্রি অব অরিজিন সংক্রান্ত ঘোষণা পুরোপুরি অনলাইনভিত্তিক হওয়ায় রপ্তানিকারকরা বাড়তি সময়, হয়রানি ও অবৈধ অর্থ ব্যয় থেকে অনেকটাই মুক্তি পেয়েছেন।
রেজিস্টার্ড এক্সপোর্টার সিস্টেম বা রেক্স হিসেবে পরিচিত এই পদ্ধতিকে তারা ইজ অব ডুয়িং বিজনেসের ভালো উদাহরণ হিসেবে দেখছেন। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ সরকারের অন্যান্য অফিসেও একইভাবে অনলাইন পদ্ধতি কার্যকর করার তাগিদ দিয়েছেন রপ্তানিকারকরা।
বাংলাদেশ ইউরোপে জেনারেলাইজড সিস্টেম অব পেফারেন্সেস (জিএসপি) এর আওতায় প্রায় সব পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। কিন্তু অন্য প্রতিযোগী দেশগুলোকে শুল্ক পরিশোধ করে সেখানে প্রবেশ করতে হয়।
জিএসপির আওতায় ইইউতে বাংলাদেশি পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার জন্য সেখানকার বন্দর থেকে পণ্য শুল্কায়নকালে কান্ট্রি অব অরিজিন ঘোষণা কিংবা সনদ দেখাতে হয়; যা বর্তমান রেক্স চালু হওয়ার আগে ইপিবি থেকে ম্যানুয়ালি নিতে হতো।
এজন্য একগাদা রপ্তানি সংক্রান্ত ডকুমেন্ট জমা দেওয়া ছাড়াও ইপিবি কর্মকর্তাদের সিল ও স্বাক্ষরের প্রয়োজন হতো। এজন্য প্রায় প্রতিটি পণ্য চালানে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা করে ঘুষ দিতে হতো বলে অভিযোগ রয়েছে রপ্তানিকারকদের।
এতে করে প্রতি বছর ইউরোপগামী রপ্তানি চালানোর জন্য কয়েক কোটি টাকা কেবল ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ ছিলো। যা নিয়ে ইপিবির ভেতর ও বাইরে একটি শক্তিশালী চক্রও গড়ে উঠেছিলো।
আবার এই পদ্ধতিতে জিএসপি সনদ নিয়ে অনিয়মের বেশকিছু অভিযোগও আসে ইউরোপ থেকে। মাঝেমাঝেই বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির আড়ালে অন্য দেশের (যাদের উপর শুল্ক প্রযোজ্য) রপ্তানির কথা শোনা যেত।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ছাড়াও জিএসপি সুবিধাপ্রাপ্ত অন্যান্য দেশের জন্য রেক্স পদ্ধতি চালু করে ইউরোপ, যা পরীক্ষামূলকভাবে ২০১৯ সাল থেকে শুরু হয় বাংলাদেশে। শুরুতে ঢিমেতালে চলার পর বাংলাদেশের এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো (ইপিবি) গত বছরের আগস্ট থেকে তা পুরোদমে অনলাইনভিত্তিক চালু করেছে।
রেক্স পদ্ধতিতে রপ্তানিকারক নিজের রপ্তানিকৃত পণ্যের কান্ট্রি অব অরিজিনের ঘোষণা নিজেই দেন, যার জন্য তাকে ইপিবিতে রেজিস্ট্রার্ড হতে হয়।
রপ্তানিকারকরা জিএসপি'র ঘোষণার নতুন এ পদ্ধতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে সরকারের অন্যান্য দপ্তরকেও এ ধরনের অনলাইনভিত্তিক সেবার আওতায় আনার তাগিদ দিয়েছেন।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. শহীদুল্লাহ আজিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "রেক্স পদ্ধতি চালু হওয়ার পর আমাদের হয়রানি ও খরচ কমেছে। যতই অনলাইন পদ্ধতি হবে, হয়রানি ও অনিয়মের সুযোগ কমে যাবে। আমরা চাই, কাস্টমসসহ সরকারের অন্যান্য বিভাগেও এভাবে সব কার্যক্রম অনলাইনভিত্তিক হোক।"
দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কমার্শিয়াল বিভাগের একজন কর্মকতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, "আগে প্রতিটি কনসাইনমেন্টের জিএসপি সনদের কান্ট্রি অব অরিজিনের ডিক্লারেশনের অনুমোদন পেতে ইপিবিতে যেতে হতো। সেখানে প্রতিটি ফাইলের ইপিবি'র চার্জ ছাড়াও তিন থেকে চারশ' টাকা ঘুষ দিতে হতো।"
"কিন্তু নতুন পদ্ধতি চালু হওয়ার পর আমাদের আর ইপিবি অফিসে যাওয়ার দরকার হয় না। এখন আমরা নিজেরাই সরাসরি ইউরোপের বায়ারের কাছে জিএসপির ঘোষণা দিই। আর ইপিবির কাছেও এসব তথ্য পাঠিয়ে দিই রেকর্ড রাখার জন্য। পুরো প্রক্রিয়া অনলাইনে হয়," বলেন তিনি।
বর্তমানে ইপিবি'র আড়াইশ টাকা চার্জের বাইরে কোনো বাড়তি অর্থ ব্যয় হচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন তিনি। ইপিবি অফিসে গিয়ে সময়ও নষ্ট হচ্ছে না।
সরেজমিনে রাজধানীর কাওরানবাজারে টিসিবি ভবনে অবস্থিত ইপিবির জিএসপি সংক্রান্ত বিভাগে গিয়ে তাদের কথার সত্যতা পাওয়া গেল। রেক্স চালু হওয়ার আগে ওই এরিয়ায় বিভিন্ন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কমার্শিয়াল বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীদের ভিড়, আর ফাইলের স্তুপ দেখা যেত।
অথচ এখন ইইউ গামী রপ্তানি চালানের কান্ট্রি অব অরিজিন সংক্রান্ত সনদ নিতে কাউকে সশরীরে আসতে হচ্ছে না। এর বাইরে তুরস্ক, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের রপ্তানি চালানের ক্ষেত্রেও একই পন্থায় অনলাইনে কান্ট্রি অব অরিজিনের ঘোষণা দেওয়া যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ বাণিজ্য ও ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান মনে করেন, ইইউ'র রেক্স পদ্ধতি সব পক্ষের জন্যই সুবিধাজনক হয়েছে। এটি বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের ব্যবসা সহজ করার পাশাপাশি ব্যয়ও কমিয়েছে। আবার অন্যদিকে বিদেশি আমদানিকারক ও বাংলাদেশি রপ্তানিকারককেও দায়দায়িত্বের মধ্যে এনেছে।
তিনি বলেন, "ম্যান টু ম্যান কনটাক্ট যত কমানো যায়, দুর্নীতির সুযোগ তত কমে যায়। দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেরও সেবা একইভাবে অনলাইন পদ্ধতির আওতায় আনা উচিত।"
তবে ইউরোপের বাইরে অন্যান্য দেশের রপ্তানি চালানে (যেখানে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পায়) জিএসপি কিংবা কান্ট্রি অব অরিজিন সনদ এখনো ম্যানুয়াল হওয়ায় রপ্তানিকারকদের প্রতিনিধিদের আসতে হচ্ছে।
এ পদ্ধতি চালু হওয়ার আগে রপ্তানির বিপরীতে পণ্য চালান জাহাজে তোলার পর শিপিং বিল, ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট, বিল অব লেডিং ইত্যাদি নথিপত্রসহ জিএসপি ফরম পূরণ করে ইপিবিতে পাঠানো হতো। ওইসব ডকুমেন্ট পরীক্ষা করে ইপিবি কর্মকর্তারা সেখানে সিল ও স্বাক্ষর করে নিশ্চিত করতেন যে আলোচ্য পণ্যের কান্ট্রি অব অরিজিন বাংলাদেশ।
এরপর রপ্তানিকারক তা ব্যাংকের মাধ্যমে বা কুরিয়ারে ইউরোপের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঠাতেন। পণ্য ইউরোপের বন্দর থেকে খালাসের আগে ওই সনদ পৌঁছাতে হতো, যার মাধ্যমে সেখানকার আমদানিকারক শুল্কমুক্ত সুবিধায় বাংলাদেশি পণ্য খালাস করতে পারতেন।
কিন্তু ইপিবির প্রক্রিয়াটি ম্যানুয়াল হওয়ায় এবং ইপিবি অফিসে এসে কর্মকর্তাদের সিল ও সাইন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় বাড়তি সময় ব্যয় হওয়া ও আর্থিক অনিয়মের সুযোগ ছিলো।
জানা গেছে, ইতোমধ্যে ইউরোপে রপ্তানিকারক ৩ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান ইপিবির কাছ থেকে রেক্স এর রেজিস্ট্রেশন করে আইডেন্টিফিকেশন নম্বর নিয়েছে।
এই নম্বরের মাধ্যমে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান নিজেই নিজের পণ্যের কান্ট্রি অব অরিজিনের ঘেষণা ইউরোপের বায়ারের কাছে পাঠান অনলাইনে। আর অন্যান্য ডকুমেন্টসহ ইপিবিতে পাঠান, যা সেখানে রেকর্ড থাকে। এক্ষেত্রে রপ্তানিকৃত পণ্যের কান্ট্রি অব অরিজিন সংক্রান্ত দায় দায়িত্ব রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের।
ইউরোপের দেশগুলোর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ চাইলে ইপিবিতে ভ্যারিফাই করে নিতে পারেন, ওই রপ্তানিকারক ইপিবির রেজিস্ট্যার্ড কি না।
ইপিবির ডিরেক্টর কুমকুম সুলতানা টিবিএসকে বলেন, "রেক্স পদ্ধতি চালু হওয়ার পর এখন রপ্তানিকারক কর্তৃক দাখিলকৃত কাগজপত্রের পোস্ট ভ্যারিফিকেশন হয়। এছাড়া যেসব কনসাইনমেন্টের কাগজপত্র ভেরিফিকেশনের জন্য ইউরোপ থেকে চাওয়া হয়।"
সন্দেহজনক পণ্য চালান কিংবা নন টেক্সটাইল পণ্যের কাগজপত্র বিশেষভাবে ভ্যারিফিকেশন করা হয় বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, যারা তাদের কাছে রেক্স এর মাধ্যমে জমা দেয়, সেটিই কেবল পরীক্ষা করা সম্ভব হয়।
অবশ্য ইইউতে কী পরিমাণ কান্ট্রি অব অরিজিন সংক্রান্ত ঘোষণা বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে যায়, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায়নি ইপিবি'র কাছ থেকে।
কুমকুম সুলতানা বলেন, নতুন করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ইপিবি'র ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন করার সুবিধার্থে ইন্টিগ্রেশন হওয়ায় এখন থেকে এ তথ্য পাওয়া সহজ হবে।
তবে ইউরোপে এই সংখ্যা বছরে দুই থেকে আড়াই লাখ হবে বলে মনে করছেন বিকেএমইএ এর সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান।
ইউরোপ ছাড়া এই কান্ট্রি অব অরিজিন বা জিএসপি সনদের সংখ্যা (প্রতিটি রপ্তানির চালানের জন্য একটি সনদ) বছরে এক লাখের মত হবে বলে ইপিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র মনে করছে।
ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান আ হ ম আহসান টিবিএসকে বলেন, "রেক্স পদ্ধতি চালু হওয়ার পর এখন আর রপ্তানিকারকদের প্রতিনিধিদের ইপিবিতে আসতে হয় না। অনলাইনে সব কাজ হয়েছে, যা ইজ অব ডুয়িং বিজনেসের ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি।"
বর্তমানে ইপিবিতে পাঠানো ডকুমেন্ট সংরক্ষণের জন্য সফটওয়্যার চার্জ হিসেবে প্রতিটি চালানের রেক্স ডিক্লারেশন রেকর্ড রাখার জন্য ইপিবি ২৫০ টাকা করে নিচ্ছে, যার সঙ্গে রপ্তানিকারকরা একমত নন।
ফজলে শামীম এহসান বলেন, সার্কভুক্ত অন্য দেশসহ বিশ্বের কোনও দেশে এই সেবার জন্য কোন টাকা দিতে হয় না। তাহলে বাংলাদেশে দিতে হবে কেন?"