‘হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর মাঝে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির তাৎপর্য কী?’
এ যেন প্রদীপের নিচের অন্ধকার দিক। উজ্জ্বল দিকটিতে ৫৭ লাখ অধিবাসীর এক পরিপাটি অর্থনৈতিক কেন্দ্র টিকাকরণ হার বাড়ার সুবাদে ধীরে ধীরে সামাজিক দূরত্বের বিধি-নিষেধ শিথিল করছে। নগর রাষ্ট্রটির বাসিন্দারাও তার ফলে নিকট ভবিষ্যতে ছুটি কাটাতে ভ্রমণের দিবাস্বপ্ন দেখছেন। অন্যদিকে, ফেরিতে করে সামান্য দূরত্বে অপর পাড়ে গেলে দেখা মিলবে মর্মস্পর্শী চিত্রের। যেখানে ২৭ কোটি জনসংখ্যার প্রতিবেশী রাষ্ট্র অক্সিজেন সংকটে ভুগছে, বাড়ছে কোভিড সংক্রমিতের দৈনিক সংখ্যা যা ২০ হাজারেরও বেশি এবং মৃত্যুর মিছিল ছাড়িয়েছে ৬০ হাজারের ঘর।
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দুই নিকটতম প্রতিবেশী সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত এ অবস্থা- এশিয়ার অন্যান্য ধনী-দরিদ্র দেশেরই আখ্যান। এতে করে স্পষ্টতই বোঝা যায়, এ অঞ্চলে যেকোনো প্রকার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ঘটলেও তাতে অংশহগ্রহণ থাকবে না কোটি কোটি মানুষের।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএফএফ) এর পূর্বাভাস অনুসারে, চলতি বছর এশিয়া ৭.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। যার পেছনে সিংহভাগ অবদান রাখবে দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুর এবং বিশ্বের উৎপাদন কেন্দ্র ও রপ্তানি পাওয়ারহাউজ খ্যাত চীন। অন্যদিকে, রোগ প্রতিরোধে ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণে সে তুলনায় অনেক পিছিয়ে পড়বে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও মালয়েশিয়ার মতো রাষ্ট্রগুলো। তাই পূর্বাভাসের উজ্জ্বল আলোকছটা সবচেয়ে প্রভাবিত জাতিগুলো যে অন্ধকার খাদে পড়েছে এবং সেখান থেকে উত্তরণে তাদের যে প্রাণান্তকর দুর্গতির মই বেয়ে উঠতে হবে-তার প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরে না।
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় কোভিড-১৯ মহামারির গ্রাউন্ড জিরো এখন ইন্দোনেশিয়া। রাজধানী জাকার্তায় আক্রান্ত রোগীর হাসপাতালে ভর্তির হার ৯০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। হাসপাতালের বাইরেও তাঁবু টাঙ্গিয়ে ও আবাসিক অ্যাপার্টমেন্টে অস্থায়ী আইসোলেশন ইউনিট চালু করেছে কর্তৃপক্ষ।
গেল সপ্তাহে ইন্দোনেশিয়ার এক লাখ কোটি ডলারের অর্থনীতিতে অর্ধেকের বেশি অবদান রাখা জাভা ও বালি দ্বীপে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেন প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো। অথচ এ কড়াকড়ি আরোপের কিছুদিন আগেই বালি আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কারণ, জোকোই এর আগে বড় পরিসরে লকডাউনের বিরোধিতা করে দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক বিধিনিষেধ আরোপের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু, সংক্রমণ ও মৃত্যু হার আকাশছোঁয়া মাত্রায় পৌঁছানোর পর, তিনি সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। আর দেশটির জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তারা এখন সংক্রমণ আরও বৃদ্ধির হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন।
শুরু থেকেই ভাইরাসের বিস্তার রোধে ইন্দোনেশিয়ার পদক্ষেপ ছিল অপর্যাপ্ত। ভাইরাস পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার অনেক পরে গত বছরের মার্চে প্রথম সংক্রমণের সত্যতা নিশ্চিত করেন ইন্দোনেশিয় কর্মকর্তারা। তাছাড়া, অঞ্চলভেদে ছোট পরিসরের লকডাউন আরোপ জনমনে বিভ্রান্তির জন্ম দেয়। ফলে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ হানা দেওয়ার আগে দেশটি নতুন কেস সংখ্যা বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরার সক্ষমতাও অর্জন করতে পারেনি। অবশ্য ইন্দোনেশিয়ার অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের উৎস শুধুমাত্র করোনাভাইরাস দুর্যোগ এমন দাবি করাটাও যথাযথ নয়।
প্রেসিডেন্ট জোকোই তার দ্বিতীয় দফার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করার মাঝামাঝি সময়ে রয়েছেন। তাকে পুনঃনির্বাচিত করার সময় অনেক আশা করেছিল ইন্দোনেশিয়াবাসী, কিন্তু তিনি সেসব প্রত্যাশা পূরণে হোঁচট খেয়েছেন। অথচ অর্থনৈতিক নবজাগরণের গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপকরণ আছে ইন্দোনেশিয়ার; এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশে বার্ধক্য যখন বাড়বাড়ন্ত, তখন ইন্দোনেশিয়ায় আছে বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী। দেশটির ওপর আছে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা, তাই মহামারি হানা দেওয়ার কালেও তারা দেশটির মুদ্রানীতির পরীক্ষামূলক পরিবর্তনকে স্বাগত জানান।
জোকোই পাঁচ শতাংশের গড়পড়তা প্রবৃদ্ধির ঘর থেকে তার দেশের উত্তরণে গেল বছর শ্রম আইন সংশোধনের মতো বেশকিছু দৃঢ় পদক্ষেপও নেন, যা ছিল ব্যবসা-বান্ধব। কিন্তু এসব প্রচেষ্টা থেকে সুফল পাওয়া এখনও বাকি। ইন্দোনেশিয়ার সম্ভাবনা নিয়ে বরাবর ইতিবাচক আভাস থাকলেও এই মুহূর্তে দেশটির অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ হয়ে পড়েছে সম্পূর্ণ অনিশ্চিত।
হংকং ও সিঙ্গাপুরের মতো আর্থিক কেন্দ্রগুলোর পুনঃউন্মুক্তকরণের পথে থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হলেও, এশিয়ার সিংহভাগ অঞ্চল এখনও কোভিডের বিরুদ্ধে জীবনমরণ সংগ্রামে লিপ্ত। এসব দেশে দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা লাখের ঘরে এবং টিকাকরণের হারও সন্তোষজনক পর্যায়ে না থাকায় অচিরেই ভ্রমণ চালুর সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। তার ওপর জনবহুল নগর ও ঘন বসতির দ্বীপগুলোর কারণে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের মতো রাষ্ট্রে এ সমস্যা চরম আকার ধারণ করেছে। গত জানুয়ারি থেকে জরুরি অবস্থার মধ্যে আছে মালয়েশিয়াও। ব্লুমবার্গের সংগৃহীত তথ্যানুসারে, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশই টিকা পেয়েছে।
গত সপ্তাহে স্থানীয় গণমাধ্যম স্ট্রেইটস টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্যমন্ত্রী চলতি বছরের শেষ নাগাদ কোয়ারেন্টিন মুক্ত ভ্রমণ চালুর ব্যাপারে আশা প্রকাশ করেন। তবে এ সুবিধা শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মতো টিকাকরণে অঞ্চলের ক্ষেত্রে দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি। তার বক্তব্যে স্পষ্ট বোঝা যায়, যেসব দেশে সংক্রমণ হার কমছে ও টিকাহার সন্তোষজনক তাদের সঙ্গেই মুক্ত ভ্রমণের সুবিধা দেবে সিঙ্গাপুর। অর্থাৎ, এ সুবিধা পাওয়ার ধারেকাছেও নেই প্রতিবেশী ইন্দোনেশিয়া। ফলে বঞ্চিত থাকবে দেশটির পর্যটন অর্থনীতি।
অথচ, এশিয়ার মোট বাণিজ্যের ৬০ শতাংশই হয় প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে। অঞ্চলটি এতো গভীরভাবে পরস্পর সম্পর্কিত যে মহামারির বিরুদ্ধে একক জয় উদযাপনের অবকাশ নেই। আর নৌযানে বা সেতু পাড়ি দিয়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশের ভূখণ্ডে পা রাখলেই আপনি আঞ্চলিক অর্থনীতির মসৃণ আভাস যে চিত্র তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে তার ইঙ্গিত পাবেন।
- লেখক: ড্যানিয়েল মস ব্লুমবার্গের এশীয় অর্থনীতি বিষয়ক মতামত কলামিস্ট। এর আগে তিনি ব্লুমবার্গ নিউজ ফর গ্লোবাল ইকোনমিক্সের নির্বাহী সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালনের সময় এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা শাখার নেতৃত্ব দেন।