‘সংকটের মেঘ ঘনিয়ে এলেও দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি’
৫০ বছর আগে পাকিস্তানের লুটতরাজ, ধর্ষণ ও গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যুর পর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে আজ যে অর্থনৈতিক বিস্ময় ঘটে চলেছে তা সত্যিই কল্পনাতীত।
মহামারি থেকে দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরুর ঘটনাও ঢাকার সামনে আরও সুদিনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক বৈশ্বিক ব্যাংকিং সংস্থা স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাংলাদেশ ২০২২ অর্থবছরে সাত শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। সবচেয়ে বড় যে দিকটি তারা উল্লেখ করেছে, সেটি হলো প্রবৃদ্ধির এই গতি হবে ধারাবাহিক। ফলে ২০২৬ অর্থবছরে ৫০ হাজার কোটি ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হবে বাংলাদেশ।
তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্থান ভবিষ্যতের কোনো সম্ভাবনা নয়। বরং ইতোমধ্যেই তা ঘটে গেছে। ২০২০ সালেই জিডিপি অনুপাতে ২,২২৭ মার্কিন ডলার মাথাপিছু আয় নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যায় বাংলাদেশ। এ সময় ভারতের মাথাপিছু আয় ছিল ১,৯৪৭ ও পাকিস্তানের ১,৫৪৩ ডলার।
তিনটি মূল অনুঘটক বিস্ময়কর এ প্রবৃদ্ধির পেছনে ভূমিকা রাখে। প্রথমত, প্রতিযোগী শক্তিকে কাজে লাগানোর পরীক্ষিত পথ ধরেছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে পোশাক, ওষুধ ও ফিশারিজ খাতে এর সফল প্রয়োগ করে বৈশ্বিক চাহিদা পূরণে বিপুল উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে।
গত চার দশক ধরে বাংলাদেশে পোশাক শিল্পকে সযত্নে গড়ে তোলা হয়েছে। সরকারের আর্থিক সমর্থন পেয়েছে যান্ত্রিক তাঁতশিল্প। কম মজুরির সুবিধা নিয়ে ও বিদ্যুৎ খরচ কমিয়ে প্রতিযোগী সক্ষমতা বৃদ্ধিতেও ছিল সমন্বিত পদক্ষেপ। এসময় চীন ধীরে ধীরে আরও উচ্চমানের পোশাক উৎপাদনে ঝুঁকে পড়লে বাংলাদেশের সামনে সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়।
আজ চীনের পর বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক। ২০১৯ সালে রপ্তানি করেছ ৫ হাজার কোটি ডলার মূল্যের পোশাক। মৌলিক ওষুধ ও পোশাক শিল্পে নতুন কারখানা স্থাপনে সকল সরকারের পক্ষ থেকেই সহায়তা দেওয়া হয়। কর্মসংস্থান সৃষ্টির বৃহৎ সামাজিক লক্ষ্যের অংশ হিসেবেই এসব খাতে বিনিয়োগকারীদের দেওয়া হয়েছে অনেক সুবিধা। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গতিশীল হয়ে অনেক মানুষ দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। আর্থ-সামাজিক এই সুফল ডলারপ্রতি বিনিয়োগ হিসাবের চাইতেও বৃহত্তর ভূমিকা পালন করেছে।
দ্বিতীয়ত, সস্তা শ্রমের অপেক্ষাকৃত ছোট সুবিধাটিকে কাজে লাগিয়েছে প্রতিবেশী দেশটি। যেমন, চীনে মাসিক শ্রমিক মজুরি ৬০০ ডলার (৫১ হাজার ৩৬৫ টাকা) হলেও বাংলাদেশে তা মাত্র ১৯০ ডলার (১৬ হাজার ২৬৫ টাকা)। তবে এ হিসাব মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় মূল্য কমে যাওয়ার পর। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশি শ্রমিকরা বেশ কম অর্থই পান।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, শ্রমশক্তিতে নারীর বিপুল অংশগ্রহণ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানায়, বাংলাদেশে নারী কর্মীর সংখ্যা ৩৪ শতাংশ, যা প্রতিবেশী ভারতের ২২ শতাংশের চেয়ে অনেকগুণ বেশি। ফলে জাতীয়ভাবে অর্জিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সামাজিক লিঙ্গ সমতা আনয়নে স্থানান্তর করতে পেরেছে বাংলাদেশ, আর কাজটি অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে দ্রুতগতিতেই করেছে।
পোশাক শিল্পের বড় বাজার পশ্চিমের উন্নত দেশগুলো। তারা স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুবিধা দেয়। পোশাক খাতের জন্য বরাবরই এই কোটা অর্জনে উদ্যমী ছিল বাংলাদেশ সরকার। ফলে রপ্তানি ক্রমশ বাড়তেই থাকে। বাড়ে এ খাতে বিনিয়োগ। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে উৎপাদনে উন্নততর যন্ত্রপাতি যুক্ত হয়, বাড়ে কারিগরি দক্ষতা।
পোশাক খাতে উদীয়মান বিশ্বনেতা হয়ে ওঠার পাশাপাশি বিদেশে তরুণ কর্মী পাঠিয়েও লাভবান হচ্ছে বাংলাদেশ। প্রবাসীরা বার্ষিক ২ হাজার কোটি ডলার সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে নিজ দেশে ক্ষুদ্র ব্যবসা ও কুটির শিল্প গড়ে উঠতে অবদান রাখছেন। বিদেশ থেকে স্বজনের পাঠানো অর্থে অনেক দরিদ্র পরিবার মাছ চাষ, গবাদিপশু পালন বা পরিবহন ব্যবসা করে সচ্ছলতার মুখ দেখছে। আগামী দশকে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় দ্বিগুণ হতে পারে।
এছাড়া ক্ষুদ্র ঋণেও বাংলাদেশে প্রাপ্ত মুনাফা আকর্ষণীয়, এই সুযোগ কাজে লাগাতে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করছে। যা ছোটখাটো উদ্যোগগুলোর পুঁজির যোগান দিয়ে সুষম প্রবৃদ্ধির বিপ্লব ঘটাচ্ছে।
তবে চমকপ্রদ প্রবৃদ্ধির পরও, দিগন্তে কিছু ঝুঁকির মেঘও জড়ো হচ্ছে। সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো রাজনৈতিক। ইসলামিক মৌলবাদের উত্থান দেশটির সুষম উন্নয়নের ধারা ব্যাহত করবে। শক্ত হাতে দমন না করা হলে, এই শক্তি শ্রমবাজারে নারীর প্রবেশ সীমিত করবে। বিদেশি বিনিয়োগও তখন বন্ধ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের জন্য দ্বিতীয় বড় ঝুঁকি হলো পোশাক শিল্পের ওপর অধিক নির্ভরশীলতা। প্রায় ৮৫ শতাংশ রপ্তানি এ খাত থেকেই আসছে। অবস্থা পরিবর্তনে বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়ার পরও বিকল্প সম্ভাবনাময় দুটি খাত, পাদুকা ও ওষুধ শিল্পে বিনিয়োগ এখনও অপর্যাপ্ত। তাছাড়া প্রবৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশ আত্মতুষ্টিতে ভুগছ—সেটাও বড় হুমকি।
তৃতীয় ঝুঁকিটি আসছে ভারত থেকে। নরেন্দ্র মোদির সরকার গত তিন বছর ধরে পোশাক রপ্তানিতে ভর্তুকি দিচ্ছে। তাৎক্ষণিকভাবে এর সুফলও মিলছে। চলতি বছর ভারতের পোশাক রপ্তানি ২২ শতাংশ বেড়েছে, সে তুলনায় বাংলাদেশের বেড়েছে ১৮ শতাংশ। তার ওপর বিশ্ববাজারে যদি তুলা ও সুতার দাম ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ধরে রাখে তার সাথে ভারতীয় শিল্পের ভর্তুকি সুবিধা মিলে বাংলাদেশের রপ্তানিতে ধস দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে, ভারতের তুলনামূলক অধিক উৎপাদন ক্ষমতা বাংলাদেশের রপ্তানিতে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই ভাগ বসাতে পারে। ২০২৬ সাল নাগাদ বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণ করবে- তখন এই সুবিধা আরও বেশি পাবে ভারত।
ভালোমন্দ সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিস্ময়কর প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে এই বিস্ময়ে আরও জাদুর ছোঁয়া যুক্ত করতে উদ্যমী হতে হবে।
- লেখক: নিনাদ ডি শেঠ একজন ভারতীয় সাংবাদিক
- সূত্র: ডেকান হেরাল্ড থেকে অনূদিত